মুখাবয়ব: দ্যুতিমান ভট্টাচার্যের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম
আইনরক্ষকের বিরাট দায়িত্ব, তবু পুলিশি উর্দি পরা আটচল্লিশের তরুণের অবচেতনে স্বচ্ছ জলের তলার রঙিন সব প্রবালের মতো শিল্পকলার অহরহ যাতায়াত, যা স্থির নয়। সেখান থেকেই বিবর্তিত হতে হতে উঠে আসা ভাবনা লালিত হতে থাকে রঙে-রেখায়, কাগজে-বোর্ডে। অনেক কাল থেকেই শিল্পকলার নানা ইজ়ম বা ভুবনকে চষতে থাকেন দ্যুতিমান ভট্টাচার্য। জীবিকা যা-ই হোক, জীবনকে শিল্পের সঙ্গে এই আশ্চর্য আবহে কী ভাবে যে মিলিয়ে নিয়ে তাঁর পথচলা, ‘আনন্দী আর্ট গ্যালারি’-তে সদ্যসমাপ্ত একক প্রদর্শনীই তার প্রমাণ। নিজস্ব সৃষ্টি-নির্মাণের চিন্তাভাবনার বাতাসে উড়ে বেড়ানো তুলোর বীজের মতো অজস্র রঙিন সব রূপবন্ধ, রূপারোপের এক-আধ ঝলক চমক, চেনা-অচেনা প্রতীকী তাৎপর্য, কম্পোজ়িশনের খাতিরে তাদের শরীরময় আশ্চর্য ভাঙচুর।
কোনও শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধার না ধারা এই শিল্পী নিজস্ব এক শিল্পকলার তেপান্তরে রং-তুলি-কলমের সমরাস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে বেরোনো সমরনায়ক। স্মরণে ইউরোপীয়-ভারতীয় কিছু প্রাতঃস্মরণীয় শিল্পীর কাজ, যা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের ফুটপাথ-শিল্পীর আঁকা ‘শিব’-এর বহু মুখচ্ছদেও প্রাণিত হয়েছিলেন। প্রদর্শনীর কাজগুলিতে পিকাসোরও উপস্থিতি।
দ্যুতিমানের কাজ সচিত্রকরণ নয়। প্রথাগত, পুঁথিগত শিক্ষার গণ্ডি-ভাঙা এক অন্য ধরনের ভাঙচুর। বিমূর্তায়নের ব্যর্থ, না-বোঝা নির্মাণ নয়, নিজের মধ্যে গড়ে ওঠা রূপ-অরূপের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আর এক রকম অভিঘাত। যা সংঘর্ষের চেহারায় আবর্তিত না হয়ে বরং সুদূরপ্রসারী রূপকথাময় বিবর্তন। যে রূপকথায় আছে মেক্সিকান আদিবাসী শিল্প থেকে মিশরীয় নির্যাসের রূপকল্প। টুকরো অনুষঙ্গ। নির্দিষ্ট রূপবন্ধ, এমনকি অনির্দিষ্ট হয়েও এক ধরনের ডিজ়াইন, প্যাটার্ন সম্বলিত কম্পোজ়িশনকে প্রত্যক্ষ করায়। উজ্জ্বল, অনুজ্জ্বল, চাপা বর্ণের সমাবেশ থেকে রূপ একসঙ্গে অনেক কিছুকে আঁকড়ে ধরে তৈরি করছে এক নাটকীয়তা। এখানে সামগ্রিক সন্নিবেশিত পরিবেশ ওই জড়ানো আবহে একটু হলেও জটিল হচ্ছে। দ্বৈত বর্ণের অপেক্ষাকৃত স্থূল রেখার চলন বরং আর এক রকম ডায়মেনশন তৈরি করছে। তাঁর ছবি নিঃসন্দেহে ছোটদেরও ভাল লাগবে।
জুয়ান মিরো, পল ক্লী, পিকাসো, কিউবিজ়ম থেকে প্রত্ন-ভাস্কর্যের অনুষঙ্গ, আদিম রূপের প্রতিফলন-ছোঁয়া কিছু রূপ এমন ভাবেই তৈরি হয়ে যায় রঙের সঙ্গে রেখার বুননে। রচনায় একান্তই নিজস্ব স্টাইলাইজ়েশনের একটি ধারাবাহিক মেলবন্ধন তাঁর এই টেকনিককে বুঝতে সাহায্য করে। রচনার খাতিরে কিছু ক্ষেত্রে ইংরেজি বর্ণসমূহ মানানসই ভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী ছবিতে ব্যবহার করেছেন শিল্পী। ওই যে প্রতীকী সামান্য প্রয়াস স্পেসকে কিছুটা হলেও ভাষা দিচ্ছে, সেখানে ছবি পূর্ণাঙ্গ একটি মেসেজ পৌঁছে দিচ্ছে। কী সেই মেসেজ? শিল্পীর ভাষ্যে, যা চলচ্চিত্রের বিভিন্ন চেনা চরিত্র। ‘পাল্প ফিকশন’-এর জুলস, থ্রিলার ছবি ‘কিল বিল’-এর নিপীড়ন ও প্রতিশোধ, ‘শোলে’ ছবির কিছু মুহূর্তের শিল্পীর ভাবনার প্রতিরূপ এই বার্তা। নীরদ মজুমদারের ‘পুনশ্চ পারী’, পিকাসো, কিউবিজ়ম তাঁকে ভীষণ ভাবে বদলে দিয়েছিল। ভারতীয় অবন-বিনোদ-নন্দলাল-রামকিঙ্কর, বেঙ্গল স্কুল থেকে হুসেন-সুজা-রাজা-আরাও মুগ্ধ করেছিল শিল্পীকে। যেমন কার্টুনের আর.কে.লক্ষ্মণ, মারিও মিরান্দা।
দ্যুতিমানের আইকনিক চরিত্রগুলির উপস্থাপনা ও নিজস্ব স্টাইলটিতে কোথাও একটা কার্টুন ইমেজ বা অ্যানিমেশনের প্রভাবও কাজ করেছে। তাঁর সিরিজ়টিতে পৌত্তলিক ফর্মেশন আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্পেস জুড়ে কাজ করার প্রবণতা আছে। তাই রচনায় অনেকটা জমাট ভাব আছে। ইংরেজি বর্ণের সঙ্গে স্পেসের শূন্যতার সম্পর্ককে রচনায় সেভাবেই কাজে লাগিয়েছেন। বিদ্বেষ, হিংস্রতা, বিদ্রুপ, শ্লেষ, কৌতুক, কৌতূহল...এমন সব কিছুকে রচনার ভাবনায় রেখেও প্যাটার্ন ও ক্ষুদ্র আলঙ্কারিক টুকরো-বিন্যাস ছবিকে একটা জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে। বেশি কাজ করার প্রবণতায় ধাক্কা খাচ্ছে বক্তব্যের ভাষা। এখানে সামান্য হলেও সরলীকরণের কথা ভাবতে হবে।
তাঁর ছবি সচিত্রকরণ হয়নি, কারণ দ্যুতিমান কম্পোজ়িশনে ফর্মেশনের অ্যারেঞ্জমেন্ট ও রূপবন্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিভাজনের জায়গাগুলি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। অ্যাক্রিলিকে কাজ করলেও, বিভিন্ন রকম বাক্সের ভিতরের ব্রাউন পেপারের রুক্ষ টেক্সচারটি ব্যবহার করেছেন দ্যুতিমান। স্তর থাকার ফলে ত্বকের উচ্চাবচ অবস্থাটি বর্ণের আস্তরণ পেয়ে ছবিকে নয়নাভিরাম করেছে। উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল-অপেক্ষাকৃত চাপা বর্ণের মধ্যে ইউরোপীয় নির্যাস স্পষ্ট। এখানে ভারতীয় চিত্রের অনুকৃতি নেই। সাদা রঙের ব্যবহারে মুনশিয়ানা আছে। দ্যুতিমানের ছবিতে ধাঁধা আছে, ‘খুঁজে বার করো’ গোছের।