পৌরাণিক: ‘রামায়ণ’ নিয়ে শিল্পী শুভাপ্রসন্নর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটির তরফ থেকে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হল সম্প্রতি। শিল্পী শুভাপ্রসন্নর চিত্রকর্ম নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর নাম ‘রামায়ণ’, যেখানে দর্শক তিরিশটি বেশ বড় আয়তনের ক্যানভাস দেখতে পেলেন।
মহাকাব্য এক মহারণ্য। এই মহারণ্যের দ্বারস্থ হতে হয়েছে শিল্পী-সাহিত্যিকদের বারংবার, যুগে যুগে। এ শুধু ভারতবর্ষের কথা-ই নয়। সমস্ত বিশ্বে, বিশেষত ইউরোপ-সহ নানা দেশে মহাকাব্য নিয়ে শিল্পী-সাহিত্যিকদের কত একনিষ্ঠতা, কত আরাধনা। কারণ মহাকাব্যের ভান্ডার অফুরন্ত। মহাকাব্যে ধরা থাকে সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষের জীবনের সব রকম অভিজ্ঞতা। থাকে নানা ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি— যেমন ক্রোধ, ঈর্ষা, কাম, লালসা, বিকার, আনন্দ, প্রেম, প্রেমের বিকৃতি, উদারতা এবং সবশেষে ঐশ্বরিক ভাব।
হোমারের ‘দি ওডিসি’ এবং ‘দি ইলিয়াড’ আমরা পড়েছি। দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’র সঙ্গে আমরা পরিচিত। এ ছাড়া বাইবেলের গল্প নিয়েও শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণার কোনও শেষ নেই। পুরাণ ও ইতিহাস মিলেমিশে গিয়েছে শিল্পচর্চায়, সেই পরিচয় যুগে যুগে তাঁদের তুলি-কালিতে আমরা পেয়েছি। তেমন প্রভাবেই শিল্পী শুভাপ্রসন্ন সম্প্রতি ‘রামায়ণ’-এর উপরে ভিত্তি করে একটি সিরিজ় দর্শককে উপহার দিলেন। এর আগে এই গ্যালারিতেই তাঁর কাজ দেখা গিয়েছিল, সেটি ছিল ‘মহাভারত’-এর উপরে তৈরি। তাঁর সেই ‘মহাভারত’ সিরিজ়ের দ্রৌপদীর অতুলনীয় ছবিটি এখনও চোখে ভাসে।
এই প্রদর্শনীতে শিল্পী চেষ্টা করেছেন ‘রামায়ণ’কে নানা ভাবে দেখানোর। কিন্তু কোনও ভাবেই তাঁর ধ্যানধারণা পক্ষপাতদুষ্ট নয়। রামকে ভগবান হিসেবে দেখানোর চেষ্টাও নেই, আবার রাবণকে দুর্জন হিসেবেও নয়। বেশ কিছুটা নিরপেক্ষ কথকতাই করেছেন বলা যায়। ‘রামায়ণ’-এর বহু ঘটনার চিত্রানুগ বর্ণনা দেখি এখানে। যেমন, অন্ধ মুনির দশরথকে শাপ দেওয়া, সীতাহরণ এবং জটায়ুর উপরে আক্রমণ, সীতার অগ্নিপরীক্ষা ইত্যাদি। এ ছাড়া রামের দূত হয়ে এসে হনুমানের সীতাকে আংটি দেখানো, সুগ্রীবের সঙ্গে আলাপ করানোর জন্য রাম এবং লক্ষ্মণকে হনুমানের কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া ও সুগ্রীবের কাছে হাজির করা, অহল্যা উদ্ধার, তাড়কা রাক্ষসী বধ... ইত্যাদি। ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে লবকুশের শিক্ষাগ্রহণ ছাড়াও বিবিধ ভাবের প্রতিকৃতি দেখা গেল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মন্দোদরী, তারা, মন্থরা, অঙ্গদ, রাবণ, পরশুরাম, জাম্বুবান, ত্রিশঙ্কু ইত্যাদি।
শুভাপ্রসন্নের ‘রামায়ণ’ নিয়ে করা কাজ বাস্তবানুগ নয়। তাঁর শিল্পকলা চিত্রণ নয়, অর্থাৎ চিত্র দিয়ে সজ্জিতকরণ নয়। ফিগার পেন্টিংয়ে তাঁর নিজস্ব এক রচনাশৈলী আছে, একটি বিশেষ ধরন আছে। অনেক অংশেই সেটি আধুনিক, কিন্তু এতে সম্পূর্ণ বিমূর্তকরণেরও চেষ্টা নেই। ড্রয়িংয়ের প্রয়োগকৌশল, ছবির গঠন বা কম্পোজিশন, রঙের ব্যবহার এবং তুলির টান একান্ত ভাবেই নিজস্ব।
—নিজস্ব চিত্র।
প্রথমেই বলা যাক, ‘সীতাহরণ’ ছবিটির কথা। সুন্দর হরিণটিকে দেখে তার প্রতি সীতার যে আকর্ষণ জন্মায়, সেটা ছবিতে স্পষ্ট। মধুর রস জাগাতে সক্ষম হয়েছেন শিল্পী। পটভূমির গাছগাছালিতে যে বিভিন্ন টোনের সবুজের ব্যবহার আছে, সেটিও খুব মনোরম।
সিংহাসনরতা কৌশল্যার ছবিটিও অতি মনোরম। রামের মা কৌশল্যা জীবনে শান্তি পাননি। তাঁর জীবন দুশ্চিন্তা, দুর্ঘটনার মধ্য দিয়েই কেটেছে। কিন্তু এখানে কৌশল্যা এক সুন্দর নারীমূর্তি। যেন তাঁর সৌন্দর্য ভিতর থেকে প্রস্ফুটিত। পটভূমিতে প্রাসাদের যে অংশ শিল্পী দেখিয়েছেন, সেটা ঠিক মতো সম্পূর্ণ করেননি শুভাপ্রসন্ন। সম্ভবত ইচ্ছাকৃত ভাবেই জলরঙের মতো ভাব ছেড়ে দিয়েছেন খানিকটা।
‘ক্রৌঞ্চ-মিথুন’ ছবিটির গঠনকৌশল খুবই অন্য রকম। মিথুনরত দু’টি পাখির একটিকে ব্যাধ যখন বধ করলেন, তখন তিনি অপরাধদুষ্ট হন। শিকারির অবয়ব পুরোপুরি দেখাননি শিল্পী। অর্ধেকটা ফ্রেমের বাইরে রেখেছেন। একটি পাখি উড়ে পালাচ্ছে, অপরটি মৃত। রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ব্যাধের চোখেমুখে অনবদ্য একটি নৃশংস ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। কুম্ভকর্ণের প্রতিকৃতিটিও খুবই অভিনব। সম্পূর্ণ উল্টো ভাবে এঁকেছেন ঘুমন্ত একটি মুখের ছবি। দর্শক শুধু মুখটিই দেখতে পাবেন। চওড়া গোঁফ, সমতল মুখের কুম্ভকর্ণ।
—নিজস্ব চিত্র।
এর পর আসে রাবণপত্নী মন্দোদরীর একটি প্রতিকৃতি। ব্যক্তিত্বময়ী এক নারীর সুন্দর ছবি। তিনি যেন সীতাহরণের সমস্ত ব্যাপারটা নিয়েই চিন্তান্বিত। ছবিটি খুব মনোগ্রাহী। দর্শক জানেন, মন্থরার কুপরামর্শে রামকে বনবাসে চলে যেতে হয়েছিল। কুটিল স্বভাবের মন্থরার এই প্রতিকৃতিটি দেখলে বোঝা যায়, শিল্পীর প্রতিকৃতির হাত কতটা উৎকৃষ্ট।
এ বার বলা যাক তারার পার্শ্বমুখ সম্পর্কে। মহাকাশের পটভূমিতে এই মুখে এক দার্শনিক ভাব ফুটে উঠেছে। এ মুখ ভাবান্বিত, যা নজর কাড়ে। নারীচরিত্রের প্রতি শিল্পীর কিছুটা পক্ষপাতিত্ব হয়তো থাকলেও থাকতে পারে। পুরাণের বিভিন্ন সব নারীচরিত্র শিল্পীর সমবেদনায় ডোবানো তুলির টানে কোথাও যেন অসাধারণ হয়ে ওঠে।
রাবণের দশটা মাথার যে প্রতিকৃতি শুভাপ্রসন্ন সৃষ্টি করেছেন, সেখানেও এক অদ্ভুত জিনিস নজরে পড়ে। রাবণের চেহারা কিন্তু খলনায়কের নয়, দুর্বৃত্তেরও নয়। যে পরস্ত্রী হরণ করে রেখে দেয় নিজের কাছে, সে দুষ্ট ব্যক্তির মুখের ভাব এটা নয়। শিবভক্ত রাবণের চোখেমুখে একটা সংশয় এবং বিভ্রান্তি। শিল্পীর তুলিতে রাক্ষসরাজের প্রতিও কোথাও একটা সহানুভূতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। শিল্পী শুভাপ্রসন্ন যথেষ্ট নিরপেক্ষ ভাবেই ‘রামায়ণ’-এর এই আখ্যান তেলরঙে, অ্যাক্রিলিকে বেঁধেছেন। সপ্তকাণ্ডের এই শিল্পায়ন প্রশংসার দাবি রাখে।