ন’য়ে নবগ্রহ: আর্টভার্স আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —ফাইল চিত্র।
এ বছর আর্টভার্স আয়োজিত ন্যাশনাল পেন্টিং কনটেস্টে যে সব শিল্পী পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁদের চিত্রকলা নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রদর্শনী উপস্থাপিত হল ছবি ও ঘর গ্যালারিতে। ‘নবগ্রহ’ নামের সেই প্রদর্শনীর কিউরেটর শুভঙ্কর সিংহ।
এই প্রতিযোগিতায় পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তিনটি বিভাগে। বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন। উল্লেখযোগ্য কাজের পুরস্কার আরও তিনজনকে দেওয়া হয়েছে। সবটা মিলিয়ে যাঁরা প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন, তাঁদের দেওয়া হল বিশেষ পুরস্কার। সেই কারণেই প্রদর্শনীর নাম ‘নবগ্রহ’।
শিল্পী শৌভিক বিশ্বাস রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। তিনি প্রকৃতিপ্রেমী তো বটেই, সম্পূর্ণ প্রাণিজগতের প্রতিই তাঁর গভীর অনুরাগ। বেশ কয়েকটি ছবির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবি হচ্ছে তাঁর ‘ইউনিটি’ কাজটি। বেশ বড় সাইজ়ের ক্যানভাসে মিশ্রমাধ্যমের কাজ। ক্যানভাস সারফেসের উপরে সেলাই করে আয়তন সৃষ্টি করে, তার চারপাশে চারকোল অ্যাক্রিলিক এবং গ্রাফাইট দিয়ে খুব অভিনব এক ছবি সৃষ্টি করেছেন শৌভিক। পিঁপড়ের সারি তাদের ডিমগুলোকে সরিয়ে, গুছিয়ে রাখছে একত্রিত করে। পিঁপড়ের যে জোটবদ্ধ প্রয়াসে কঠিন কাজ করে ফেলার ক্ষমতা আছে, সেটা মানুষের নেই বলেই শিল্পীর হতাশা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীটির থেকেও যে এই ব্যাপারটি শিক্ষণীয়, তা নিজের কাজে তুলে ধরতে চেয়েছেন শিল্পী।
অমন চক্রবর্তীর প্রথাগত শিল্পশিক্ষা হয়তো নেই, কিন্তু ক্যানভাসে তাঁর অ্যাক্রিলিক রঙের ব্যবহার লক্ষণীয়। অমনের যে ছবিটি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে, সেটির নাম ‘ইন্টারনেট’। শিল্পী বলতে চাইছেন যে, এ যুগে মানুষ সর্বক্ষণ ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ইত্যাদির সঙ্গে সহবাস করছে, অথচ বুঝতে পারছে না যে, আন্তর্জাল সত্যিই এক বিশাল জাল পেতে রেখেছে। খানিকটা যেন ফাঁদ পেতে মানুষকে গ্ৰাস করে ফেলছে।
প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থানাধিকারী দিবাকর রায়ের কাজের নাম ‘স্ট্রিট অব লেডি লাইফ’। ছোট কাজ, মিশ্রমাধ্যমে ক্যানভাসের উপরে। যে নারীর জীবন রাস্তায়, যে নারী শরীর বিক্রি করেই জীবনধারণ করেন, সেই নারীদের শিল্পী শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছেন। সেই রমণীর মনে হয়তো কেবলই রক্তক্ষরণ। সে বড় একা।
‘মেরিট’ বিভাগে যে প্রতিযোগী প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছেন, তিনি ভারতের পশ্চিম প্রান্তের শিল্পী মৃনি গোরলা। ক্যানভাসের উপরে অ্যাক্রিলিকের কাজ, নাম ‘কারেজ’। জঙ্গলের মধ্যে যে জনজাতির বাস, তাঁরা আসলে জীবনে কতখানি ভালবাসেন, তারই এর ভাষ্য এই কাজটি। জঙ্গলের মধ্যে এক টুকরো কমলা রঙের ত্রিভুজাকৃতি জীবন তাঁদের।
এই বিভাগেই দ্বিতীয় স্থানাধিকারী রৌপ্যপদক প্রাপ্ত সৌরভ বসুর ছবির নাম ‘কিউব’। ছবিটিতে সালভাদোর দালির অনুপ্রেরণা স্পষ্ট। এক দিকে সুপারনোভা থেকে প্রাচীন মিশরের বাক্সবন্দি মমি, অন্য দিকে আধুনিক সভ্যতায় এক শিশু বসে রুবিক’স কিউব নিয়ে খেলছে। সাররিয়েল ছবি। বাস্তববাদী ট্রিটমেন্টের কাজ।
‘মেরিট’ বিভাগেই তৃতীয় স্থানে ব্রোঞ্জ পদকপ্রাপ্ত শৈবাল বিশ্বাস। কালি-কলমের কাজ করেছেন কাগজের উপরে। পুরস্কৃত কাজটিতে একটি পেঁচার সতর্ক চাহনি দর্শকের চোখ টেনে রাখে। কলমের সূক্ষ্ম আঁচড়ে শ্রমসাধ্য, বাস্তববাদী কাজ।
বিচারকদের মনোনীত কাজের বিভাগে যাঁরা পুরস্কৃত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ছাপাই ছবির নাম ‘লেবার’। এটি একটি উডকাট। একদল শ্রমজীবী মানুষ একটা ঠেলাগাড়িতে মালপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। আজকাল ছাপাই ছবি খুব অল্প সংখ্যক শিল্পী করেন বলেই শৌভিকের এই কাজ আরও বিশেষ ভাবে চোখে পড়ে।জুরি বিভাগে দ্বিতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কিশোর জাওয়ারের ছবিটিও ছাপাই কাজ। এ ছবির নাম ‘ওল্ড মেমরি’ । উডকাটে ছোট কাজ। আয়নার সামনে এক প্রসাধনরতা রমণীর শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গের সঙ্গে আরও নানা স্মৃতিকথা মিলিয়ে বেশ একটা মজা সৃষ্টি করেছেন শিল্পী। আর এই ছাপাই কাজটিতে রঙের ব্যবহার মনোগ্ৰাহী। সবশেষে তৃতীয় স্থানাধিকারী অভীক সরকারের ছবি ‘ডিকে’। ক্যানভাসে করেছেন কাজটি, গোয়াশ এবং তেলরঙে। একটি বৃদ্ধের চিন্তান্বিত মুখাবয়ব যেন ঘোষণা করছে চারদিকের ভাঙন ও সভ্যতা সঙ্কটের বার্তা।
ন’জন শিল্পীর কাজেই বেশ চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। নতুন প্রজন্ম যে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তান্বিত, সেটা বেশ স্পষ্ট। এ ছাড়া প্রত্যেক শিল্পীই তাঁদের কাজ বেশ কিছুটা ভিন্ন শৈলীতে করতে চেষ্টা করেছেন। এঁদের মধ্যে অনেকের কাজই নিজস্ব স্বাক্ষরবাহী।