জীবন্ত: চারুবাসনা গ্যালারিতে শিল্পী বাপ্পা ভৌমিকের শিল্পকর্ম। —ফাইল চিত্র।
চারুবাসনা গ্যালারিতে তরুণ শিল্পী বাপ্পা ভৌমিকের শিল্পকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। পাশাপাশি গ্যালারির তরফ থেকে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে তাঁকে নিয়ে, যা শিল্পী উৎসর্গ করেছেন যোগেন চৌধুরীকে, তাঁর ৮৫তম জন্মদিনে। এই প্রদর্শনীতে বাপ্পার ৭২টি ছোট ছোট ড্রয়িং দেখা গেল। এ ছাড়া একটি মাঝারি মাপের ক্যানভাসে বাঘের ছবিও দেখা গেল।
শিশুকাল থেকেই ছবি আঁকায় ঝোঁক ছিল বাপ্পা ভৌমিকের। দুর্গাপুজোর আগে কুমোরটুলিতে যাতায়াত ছিল নিত্য। সেখান থেকেই শিল্পসাধনার অনুপ্রেরণা। পরবর্তী কালে বহু শিল্প প্রদর্শনী দেখেছেন এবং নামীদামি শিল্পীদের ভাবছায়ায় থেকেছেন। তবে বাপ্পার কথায়, তিনি যখন থেকে সম্পূর্ণ ভাবে চিত্রশিল্পী হবেন ঠিক করেছিলেন, তখন থেকে প্রকৃতিই হয়ে ওঠে তাঁর সবচেয়ে বড় সঙ্গী। এ ছাড়া মূলত যোগেন চৌধুরীর সান্নিধ্যে ও উৎসাহেই তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
প্রদর্শনীতে ছোট ছোট অসংখ্য ড্রয়িং দেখতে পাওয়া গেল। এই সব ড্রয়িংয়ে অজস্র পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, মানুষ এবং বাঘ দেখতে পাবেন দর্শক। ছেলেবেলা থেকে প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এই শিল্পী। জঙ্গলের আশপাশে ঘুরে বেড়ানোর নেশা ছিল তাঁর। অতিমারির সময় থেকেই আরও বেশি করে স্কেচ করতে শুরু করেন বাপ্পা। স্কেচ করার নেশা তাঁকে পেয়ে বসে এর পরে। অতিমারি কাটিয়ে এখন জীবনযাপন স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি ড্রয়িং ছাড়েননি। দিনের শুরুতেই দশ-বিশটা ড্রয়িং করে ফেলেন প্রথমে।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, বাপ্পা ভৌমিকের ড্রয়িংয়ে একমাত্রিকতা বা রৈখিকতাই শুধু নেই। সেখানে আমরা নানা জিনিস দেখতে পাই। কিছু ছবিতে আছে আয়তন এবং ভরাট ভাব। কিছু ছবিতে আবার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতায় একটা ত্রিমাত্রিক অনুভূতি। কিছু ড্রয়িংয়ের দৃঢ়তায় শিল্পী যোগেন চৌধুরীর প্রভাব লক্ষণীয়। কিন্তু বাপ্পার শুরুর কাজে সেই প্রভাব দেখা গেলেও পরে নিজের মতো করে তাঁর কাজ করার প্রয়াস প্রশংসনীয়।
এখানে ড্রয়িংগুলি বেশির ভাগই সাদাকালোয়। কিছু রঙিন ড্রয়িংও আছে। বাঘ নিয়ে কাজগুলি কিন্তু খুব সাদামাঠা নয়। বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, নানা অঙ্গবিন্যাসে এরা বিচরণ করছে। পোস্টকার্ডের উপরে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বেশ কিছু রঙিন ছবি দেখা গেল, নানা মেজাজে। বাঘেরা তো এক জায়গায় বেশি দিন থাকে না। নিজেদের ‘টেরিটরি’ বদলাতে থাকে। হয়তো চলমান পোস্টকার্ডের উপরে ভ্রাম্যমান বাঘের ছবি আঁকার কারণটাও তাই।
এখনকার ডিজিটাল জগতে হারিয়ে যাওয়া কীটপতঙ্গের কথা যেন বলতে চাইছে তাঁর ‘ইনসেক্ট’ সিরিজ়। এই সিরিজ়ের সব ড্রয়িং কাগজের উপর কলমে করা। নানা ধরনের পোকামাকড়, ফড়িং, প্রজাপতির অনবদ্য সব আঁকা আমরা দেখতে পাই। সবই কালো এবং সিপিয়া টোনে করা। সোজা বসে থাকা, বাঁকা ভাবে বসে থাকা, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা, হামাগুড়ি দিয়ে চলা... নানা ভাবে একাধিক কীটপতঙ্গের ড্রয়িং দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।
মানুষ, পশুপাখি বা কীটপতঙ্গ— যারই প্রতিমূর্তি শিল্পী এঁকেছেন, সেখানেই সেটির একটি রূপক বা কল্পচিত্র দর্শককে দেখানোর চেষ্টা রয়েছে তাঁর। বাপ্পার কাজের মধ্যে একটা গভীর উপলব্ধি দর্শককে নাড়া দেয়। চেনা জিনিসকে নতুন করে দেখানোর প্রচেষ্টায় শিল্পী অনেকাংশেই সফল। কীটপতঙ্গ আঁকার ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা বিমূর্তকরণও আয়ত্ত করেছেন তিনি।
এ ছাড়াও যে সব ড্রয়িং এই প্রদর্শনীতে দেখা গেল, সেগুলিতে আরও একটি বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তা হল, বাপ্পা ভৌমিকের ডিজ়াইনের বোধ। একটি ড্রয়িংয়ে তিনটি হাঁসের ছবি। পুরো ড্রয়িং বাপ্পা শেষ করেননি, কিন্তু তিনটি হাঁসের মাথা এবং গলা দিয়ে ভারী সুন্দর একটা পরিশীলিত নকশা তৈরি হয়েছে। সাদা কাগজে কালো পেনের নকশা। লম্বা ঠোঁটে একটু রঙের ছোঁয়া।
এর পরে আরও একটি ছবিতে মানুষের বুড়ো আঙুলের ড্রয়িং স্টাডি করতে গিয়ে নানা ভাবে বুড়ো আঙুলটিকে দেখেছেন তিনি। হয়তো নিজের আঙুলই স্টাডি করছিলেন এবং তারপরে যেন খেলায় মেতেছেন এগুলি দিয়ে ডিজ়াইন করার জন্য। নানা ভাবে রঙিন কলমে কাপড় পরিয়েছেন বুড়ো আঙুলগুলিকে। সুন্দর একটা নকশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছে পুরো জিনিসটি। মনে হয় পোশাক পরা বেশ কয়েকটি মানুষের সমাহার।
একটি কাজে দেখা গেল, সামনের দিক থেকে একটি ব্যাঙ বসে আছে, চশমা পরা মানুষের মতো ভঙ্গিতে। থুতনিতে ডানহাত, বাঁ-হাতটি হাঁটুতে রাখা। সূক্ষ্ম রেখায় সুন্দর একটি রূপকল্প।
আরও একটি ছবিতে সাদা কাগজের পটভূমিতে উপরে সরু কলমে কিছু চিত্তাকর্ষক ড্রয়িং দেখা গেল। তার উপরে আবার মোটা কলমের বলিষ্ঠ ছন্দে কিছু মানুষের মুখাবয়ব। আর ওই মুখগুলিতে বিভিন্ন রকমের অভিব্যক্তি। সেগুলি পিছনের সূক্ষ্ম ড্রয়িংয়ের উপরে বেশ সুন্দর একটা ডিজ়াইন বা নকশা সৃষ্টি করে রেখেছে।
সবশেষে দেখা যায় একটি মাঝারি আকারের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে করা বাঘের প্রতিকৃতি। ছবিটি অত্যন্ত রঙিন। এখানে একটি বাঘ আঁকা হয়নি। মাঝে এক বাঘের মাথা এবং একই শরীর থেকে উদ্ভূত দু’দিকে আরও দু’টি মাথা। কাছাকাছি শত্রু শনাক্ত করলে বাঘের মুখে যে অভিব্যক্তি হয়, এখানেও তিনটি মুখের তিন দিকে সেই রকম হিংস্র ভাব। তিনটি মুখ তিন দিকে দেখে মনে হয়, বাঘ যে চতুর্দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে সব সময়ে, সেটাই দেখাতে চেয়েছেন শিল্পী। এটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে মাথায় রেখে করা হয়েছে। প্রদর্শনীর সব কাজেই শিল্পীর নান্দনিকতা, মাত্রাবোধ ও অঙ্কনশৈলীর বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়।