অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর। উদ্যোক্তাদের বলে দিচ্ছেন, তাঁর অভিনীত কোনও চরিত্রকে যেন পুরস্কারের জন্য ভাবা না হয়!
তাঁর বিশ্বাস, যতই প্রশংসা করা হোক, শেষমেশ সেরার শিরোপা পাবেন এমন কেউ, যাঁর অভিনয়কে হয়তো দশে এক দেবেন তিনি স্বয়ং।
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি।
আজকাল মাঝে মাঝেই হতাশায় ভোগেন। নিজের কেরিয়ার নিয়েও হাজারটা প্রশ্ন ভিড় করে মনে। কখনও মনে হয়, বলিউডের চলতি সময়টাই তাঁর জন্য নয়।
ঠিক এমনই দোলাচলে থাকা নওয়াজকে যখন ফোনে ধরা গেল তখন তিনি ভারসোভা-র বাড়িতে। সন্ধে হয়-হয়। সারা রাত শ্যুটিংয়ের জন্য তৈরি হচ্ছেন।
বেশ কয়েক দিন ধরে ভাল করে ঘুমোতে পারেননি। কাজের ক্লান্তিতে নয়, প্রিয় অভিনেতা ওম পুরী আর কোনও দিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন না, অবিশ্বাস্য এই কাণ্ডটি যে ঘটে গেছে অল্প কয়েক দিন আগেই, তাই...!
‘‘এখন সবাই ওঁর অভিনয় নিয়ে এত চোখের জল ফেলছেন, কিন্তু একবারও কেউ ভেবে দেখেছেন, ওঁর মতো অভিনেতা সারা জীবনে কতটুকু স্বীকৃতি পেয়ে গেলেন?,’’ ঘুম-ঘুম গলায় নওয়াজের প্রশ্ন।
‘‘এখানে তো অভিনেতার কোনও কদর নেই। যদি ওম পুরীজিকে শেষ জীবনে স্রেফ পয়সার জন্য টুকরো কাজ করে যেতে হয়, আমাদের অবস্থাটা ভাবুন একবার,’’ চোরা আবেগ ছড়িয়ে পড়ল বিয়াল্লিশ বছরের অভিনেতার গলায়, যাঁকে কয়েক বছর আগে বলিউডের কয়েক জন বিদ্রুপ করে নাম দিয়েছিলেন, ‘‘গরিবোঁ কা নওয়াজ।’’
শাহরুখ ‘পাগল’
তিনিও তাই
আগামী সপ্তাহে সেই ‘গরিব’-এর সঙ্গেই অবশ্য স্ক্রিন শেয়ার করবেন বলিউডের বাদশা।
শাহরুখ খান!
এটাই নওয়াজের সেরা ছবি, বলে দিয়েছেন স্বয়ং শাহরুখ। এবং, এই একটা কথা বোধহয় বাদশা-নওয়াজের ডুয়েলটাকে একটু হলেও চড়িয়ে দিয়েছে।
‘‘শাহরুখের সঙ্গে কাজ করার একটা আলাদা মজা আছে। অত বড় অভিনেতা, অথচ যখন সেটে আসে, তখন একদম সাধারণ মানুষ,’’ বলছিলেন নওয়াজ। এবং বোধহয় সেই কারণেই ‘রইস’য়ে দু’জনের কেমিস্ট্রি নিয়ে উত্তাল গোটা দেশ। ‘‘দু’জনেই আসলে ভাল কাজের জন্য পাগল, তাই বোধহয়...,’’ বলছিলেন তিনি।
স্বর পাল্টে গেল একটু বাদেই। হঠাৎই বলে বসলেন—‘‘মাঝে মাঝে মনে হয়, ভুল সময়ে জন্মেছি। যে রকম কাজ করতে চাই, সেটা হয় না। আর যেগুলো হয়, সেগুলোয় অনেক সময়ই মন ভরে না।’’
নিজের নতুন ছবি ‘হারামখোর’ মুক্তি পেয়েছে গত সপ্তাহে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালে সেরার স্বীকৃতি পেলেও, সেই ছবি দেশের দর্শক দেখছেন প্রায় চার বছর পর। এ কথা তুলতেই আবার ক্ষোভ তাঁর গলায়।—
‘‘আসলে আমাদের দেশে অধিকাংশ পরিচালকই একটা গণ্ডির বাইরে বেরোন না। সেই পাঁচটা গান, একটা ফাইট সিকোয়েন্স, আর শেষ পর্যন্ত নায়ক-নায়িকার মিলন। এই হচ্ছে অধিকাংশ মেনস্ট্রিম সিনেমার ভাষা,’’ ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন যেন!
কয়েক বছর আগে যখন অনুরাগ কাশ্যপ, সুজয় ঘোষ-রা অন্য ধারার ছবির ধারণাটা বদলানোর চেষ্টা করছিলেন, তখন সেই ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’ নিয়ে সবচেয়ে আশাবাদী যিনি ছিলেন, তাঁরই নাম নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি।
‘‘তবে আমরা বোধহয় ভুল ভাবছিলাম। যে ছবি ফেস্টিভ্যালে ভাল করছিল, আমরা ভাবছিলাম সেগুলো এখানেও ভাল করবে। কিন্তু...,’’ বলছিলেন নওয়াজ।
কয়েক সেকেন্ড থেমে যোগ করলেন, ‘‘আজকাল মাঝেমধ্যে বুঝতে পারি না যে, দর্শক ঠিক কী চায়? খুব ডিপ্রেসড লাগে মাঝেমাঝে। যে ছবিগুলো বিদেশে এত ভাল করে, সেগুলো তো আবার অনেক সময় এখানে মুক্তিই পায় না চট করে...!’’
নাচতে শিখছেন, বাঁচতেও
গত ছ’বছরে আটটা ছবিতে তিনি নায়ক। অথচ, তার একটাও এখনও রিলিজ করেনি।
আদৌ করবে যে, সেটাও হলফ করে বলতে পারছেন না তিনি স্বয়ং।
তবু, ওই রকম অন্য ধারার ছবিই আরও করতে চান নওয়াজ।—‘‘পপুলার ছবি করলে পেট ভরবে ঠিকই, কিন্তু মন ভরবে না যে! ওই ছবিগুলো না করলে বাঁচতে পারব না তো। স্বপ্নও দেখতে পারব না যে,’’ বলছিলেন।
যখন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র ‘আনোয়ার কা আজব কিস্সা’ শ্যুট করতে কলকাতায় এসেছিলেন, ভেবেছিলেন বুদ্ধদেবের সেই ছবি তাক লাগিয়ে দেবে দেশের দর্শকদের। কিন্তু সেই ‘কিস্সা’ ফেস্টিভ্যালের বাইরে মুক্তি পায়নি আজও।
‘‘প্রতিটা ফ্লপ বা মুক্তি না পাওয়া ছবি থেকেও কত কিছু শেখার আছে। ছবি বেরোবে কি না বেরোবে, এই নিয়ে ভাবলে তো অভিনেতা কোনও দিন কাজই করতে পারবে না। বুদ্ধদা’র ওই ছবিটা করার পরই তো আরও ভাল কাজ করেছি। শিখছি তো প্রত্যেক দিন,’’ তিনি বলছিলেন।
বলিউডে তাঁর ঘনিষ্ঠরাও মানছেন এই কয়েক বছরে সত্যিই অনেক কিছু শিখেছেন নওয়াজ। যেমন, নাচ। প্রশ্ন করতেই একটু হাসলেন। স্বীকার করলেন ‘মুন্না মাইকেল’ ছবির জন্য নাচ শেখাটা জরুরি ছিল। ‘‘আমি একটুও নাচতে পারতাম না আগে। ভালও লাগত না। কিন্তু একদিন মনে হল, যদি
ছবির প্রয়োজনে গরিবের ছেলে গল্ফ খেলতে পারে, তা হলে নাচতে পারবে না কেন?’’ বলছিলেন বলিউডের ‘ফ্রিকি আলি’।
আসলে, নাচ নয়, অন্য ধারার ছবি যে তাঁকে শুধু অভিনয়ই শেখায়নি, শিখিয়েছে বাঁচতেও।—
‘‘মুম্বইয়ের রাস্তায় যখন খালি পেটে ঘুরে বেড়াতাম, তখন যেমন বাঁচার ইচ্ছেটা ছিল। আজও তাই মনে হয়। ভাগ্যিস এতগুলো রিলিজ না হওয়া ছবি ছিল!’’
সৃজিতকে বলেছেন
আমাকে নাও
‘‘বাঙালি ডিরেক্টররা আমায় খুব ভালবাসেন বোধহয়...’’ কথা বলতে বলতেই ইয়ার্কির সুরে বলছিলেন ‘কহানি’-র ইন্সপেক্টর খান।
এবং খুব ভুল যে বলেননি, তার প্রমাণ দেয় তাঁর সিভিতে এতগুলো বাঙালি পরিচালকের নাম।— সুজয় ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ঋভু দাশগুপ্ত...
এ বার নওয়াজের ইচ্ছে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অন্তত একটা বাংলা ছবি করার।
গত বছর একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে একসঙ্গে মেলবোর্ন গিয়েছিলেন দু’জনে। তখনই সৃজিতকে ইচ্ছের কথা জানান নওয়াজ।— ‘‘সৃজিতকে কিছুটা যেচেই বলেছিলাম যে, ভাল কাজ থাকলে আমাকে জানিও। ও হাসল শুধু, কিছু বলেনি,’’ নওয়াজ বলছিলেন।
তিনি অবশ্য এখনও আশাবাদী যে, ‘রাজকাহিনী’র পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ তিনি পাবেনই। ‘‘আমার কাছে ভাষাটা সমস্যা নয়। ভাল কাজের জন্য সব কিছু করতে পারি,’’ বলছিলেন ‘রইস’-য়ের এসিপি গুলাম পটেল।
‘রইস’য়ের সেটে বোধহয় এই ডেডিকেশনের জন্যই তাঁকে ‘পারফেকশনিস্ট’ বলে ডাকতেন শাহরুখ।
কথা বলতে বলতে শ্যুটিংয়ে বেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছিলেন নওয়াজ। নিজের ভারসোভা-র বিলাসবহুল ফ্ল্যাট থেকে বেরোলে আজও চোখে পড়ে রাস্তার সেই দোকানগুলো, যেখান থেকে এক সময় পাওভাজি খেতেন একবেলা।
সেই দিনগুলো ভোলেননি এই মুহূর্তের বলিউডের অন্যতম ব্যস্ত অভিনেতা। আসলে ক্যামেরা বন্ধ হলে আজও যে তিনি বুধানার সেই নওয়াজ।
‘গরিবোঁ কা নওয়াজ’!