তাঁর মায়ের কাছে বাবা বললেন, ‘‘তোমার এই ছোট ছেলেটির লেখাপড়া কিচ্ছু হবে না। রেসিটেশন শিখছে, নকল-টকল করতে পারে। যাত্রা, থিয়েটারে নোটো সেজেই ওর দিন যাবে।’’
কী অমোঘ ছিল সেই পর্যবেক্ষণ! বিকাশ রায় নিজেই পরে বলেছেন, ‘‘বাবার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। নোটো হয়েই দিন গেল!’’
যে সময়ের কথা, বিকাশ তখন বালক। জন্ম ১৯১৬য়, নদিয়ার রানিনগরে। বিত্তবান জমিদার বংশের ছেলে। তবে পূর্বপুরুষের বাবুয়ানি এবং উড়নচণ্ডিপনায় ভাঁড়ার প্রায় সবটাই তত দিনে উজাড় হয়ে গিয়েছিল। টিকেছিল শুধু জমিদারিসূত্রে পাওয়া ‘রায়’ পদবিটুকু।
বাবা যুগলকিশোর কলকাতায় এসে সরকারি চাকরি নিলেন। যে কোনও আদর্শ পিতার মতোই তিনি চাইতেন, ছোট ছেলে ‘বিকু’ ভাল লেখাপড়া শিখে আইসিএস হোক।
বিকাশ ভর্তি হলেন ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে। কিন্তু তাঁর বেশি আগ্রহ আবৃত্তি (সেই শিক্ষা অবশ্য বাবার কাছেই শুরু), অভিনয়ে। তাই হাত-পা নেড়ে ‘পঞ্চনদীর তীরে’ আবৃত্তি করে প্রশংসা কুড়োলেও বাবা যেই ইংরেজি ট্রান্সলেশন ধরলেন, বিকুর হাল খারাপ!
ম্যাট্রিকে বাংলায় লেটার ও স্বর্ণপদক নিয়ে পাশ করলেন বিকাশ। পড়তে গেলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানেও নাটকের ভূত তাঁর ঘাড়ে। তখন ঘটল আর এক কাণ্ড! কলেজের থিয়েটারের দলে ঢুকে শরৎচন্দ্রের ‘বৈকুণ্ঠের উইল’-এ পেলেন বিনোদের ভূমিকা। চরিত্রের দাবি অনুযায়ী মদ, সিগারেট সবই দরকার। কলেজের নাটকে মদ খাওয়া দেখানোর প্রশ্নই নেই। তবে সিগারেট রেখেই মহলা হল। কিন্তু গোল বাধল শেষবেলায়। চূড়ান্ত মহলা দেখতে এসে অধ্যক্ষ রেগে আগুন। প্রেসিডেন্সির ছেলেদের নাটকে সিগারেট খাওয়া! অতএব সেটি অভিনয় থেকে ছেঁটে দেওয়া হল। যদিও সিগারেটের নেশা তত দিনে রপ্ত হয়ে গিয়েছে বিকাশের।
আর মদ? একের পর এক চলচ্চিত্রের খল চরিত্রে মদ্যপান যাঁর কাছে জলপানের চেয়েও স্বাভাবিক লেগেছে, ব্যক্তিজীবনে সেই বিকাশ রায় নেশা করবেন, এতে আশ্চর্য কী!
সত্যিই আশ্চর্য। কারণ কোনও দিন মদের গ্লাসে চুমুকটুকুও দেননি তিনি! ঘনিষ্ঠদের আড্ডায় এ সব নিয়ে মজাও করেছেন। বিকাশ রায়ের বিভিন্ন লেখার সংকলনগ্রন্থ প্রকাশের সূত্রে বইপাড়ার প্রকাশক বামাচরণ মুখোপাধ্যায় তাঁর খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। একবার বিকাশবাবুর কাছে তিনি জানতে চান, নিজে মদ না খেলে মদ্যপের নিখুঁত অনুভূতি বোঝা যায়? বিকাশবাবু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘অভিনয় তো মনে। মদ কী করবে!’’
অভিনয়ের এই সাবলীলতাই বিকাশ রায়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ। চলচ্চিত্র জগতের মানুষজন তো বটেই, একেবারে সাধারণ দর্শকও তাঁর অভিনয় প্রতিভায় মজে থেকেছেন চিরকাল। তিনি আর নেই। কিন্তু সেই স্বীকৃতি আজ পর্যন্ত একই রকম রয়ে গিয়েছে।
পুরোদস্তুর নায়ক তিনি ছিলেন না। নায়কোচিত দর্শনধারীও নন। কিন্তু চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নিজেকে তিনি বারবার যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তা ভোলার নয়। যখন খলচরিত্র করতেন, মনে হত এত ঘৃণ্য লোক আর হয় না। ’৪২ ছবিতে অত্যাচারী অফিসার মেজর ত্রিবেদীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় তো বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে। আবার যখন ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর জীবনমশাই হয়ে পর্দায় এসেছেন, ‘উত্তর ফাল্গুনী’-র মনীশ হয়েছেন, তখন সেই অভিনয় দেখে সম্ভ্রমে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শকেরা। ‘ছেলে কার’ বা ‘ছদ্মবেশী’র মতো কিছু ছবি তাঁকে চিনিয়েছে কমেডি অভিনয়ে দক্ষতার মাপকাঠিতে।
বিকাশ রায়ের পাকাপাকি ভাবে অভিনয়ে আসার আগের পথটি কিন্তু খুব মসৃণ ছিল না। চড়াই-উতরাই ছিল বিস্তর। সংসার প্রতিপালনের জন্য কঠিন লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। বিলেত ফেরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট দাদার অকালমৃত্যু, বাবার চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে পরিবারে নিদারুণ অর্থকষ্ট, তারই মধ্যে তাঁর বিয়ে। অন্নসংস্থানের জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি ছিল তাঁর। সকালে টিউশন দিয়ে শুরু হত দিন। তার পরে বাসভাড়া বাঁচাতে ভবানীপুর থেকে হেঁটে হাইকোর্ট পাড়া। ভাগ্যান্বেষণে এ দুয়ার, সে দুয়ার।
প্রেসিডেন্সি থেকে অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেছেন, আইন পাশ করেছেন। ওকালতি করতে গিয়েও সুবিধে হয়নি। বহু ঘাটে ঘুরতে ঘুরতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজারে অল্প দিন মোটা বেতনে সিভিল ডিফেন্সে পাবলিসিটির চাকরিও করলেন। কাজ করলেন একটি এরোড্রম তৈরির অফিসেও। কিন্তু কোনওটিই তাঁর জীবনে স্থায়ী হল না। অনেক কম টাকায় যোগ দিলেন রেডিয়োর চাকরিতে। মাইক্রোফোনের আকর্ষণ তাঁকে টেনেছিল। নানা বাঁক ঘুরে সেখান থেকেই তিনি এক সময় পৌঁছলেন সিনেমার জগতে। দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। সিনেমায় নামার আগে স্ত্রীর ‘অনুমতি’ নিয়েছিলেন বিকাশ। কারণ এমন একটি কাজে পদে পদে নানা হাতছানি থাকে, নিন্দা রটতেও দেরি হয় না। স্ত্রী কিন্তু মুক্তমনে সায় দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, তাঁর স্বামী কত ‘খাঁটি’।
‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে
বিকাশবাবুর একমাত্র পুত্র বিজ্ঞান গবেষক সুমিত রায় ৫৪ বছর আমেরিকা প্রবাসী। পিতৃস্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ওই ঘটনা শুনিয়েছেন তিনিই। বলেছেন, ‘‘আমার ঠাকুরদা তখনও জীবিত। তিনিও মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘শুনেছি সিনেমা লাইনটা অতি খারাপ। লোকে নাকি কুসংসর্গে পড়ে, সংসার উচ্ছন্নে যায়। বিকু এই লাইনে গেলে সামলাতে পারবে তো?’ মা সম্মতি দিয়েছিলেন এবং বাবা আজীবন পরিবারের সেই মর্যাদা রক্ষা করেছেন।’’
১৯৪৭-এ মুক্তি পায় বিকাশ রায় অভিনীত প্রথম ছবি ‘অভিযাত্রী’। ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য, শিল্পী নির্বাচন ইত্যাদির দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাঁর রেডিয়ো-জীবনের বন্ধু জ্যোতির্ময় রায়। তিনিই নিয়ে যান বিকাশবাবুকে। আশ্বাস ছিল, নায়ক হবেন। পেলেন চার নম্বর চরিত্র। পাঁচ হাজার টাকাও। মন না মানলেও অবস্থা তা মেনে নিতে বাধ্য করল। এবং বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ পেয়ে গেল অভিনেতা বিকাশ রায়কে।
প্রথম ছবির পরিচালক হেমেন গুপ্তের কাছেই বিকাশবাবুর দ্বিতীয় ছবি ‘ভুলি নাই’। সেই সঙ্গে পরিচালকের সহকারী হয়ে বুঝতে শুরু করলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্ধিসন্ধি। যেটা পরবর্তী কালে বিকাশকে নানা ভাবে সাহায্য করেছে। পরিচালনা, চিত্রনাট্য তৈরি, প্রযোজনা— সব ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণে দীর্ঘ সময় জুড়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ছবি।
১৯৫১ সাল। একের পর এক ছবি করতে করতে অভিনেতা বিকাশ রায় তখন বেশ পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন। সেই সময় হেমেনবাবু তৈরি করেন ’৪২। ছবিটিতে নৃশংস অত্যাচারী মেজর ত্রিবেদীর ভূমিকায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করেন বিকাশ রায়। দেশ তখন স্বাধীন হওয়ার আবেগে উত্তাল। পর্দায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর মেজরের অত্যাচার দেখতে দেখতে মানুষ এতটাই খেপে উঠেছিল যে, রাস্তাঘাটে বিকাশ রায়কে দেখলে তাড়া করার ঘটনাও ঘটত। ছবির প্রিমিয়ারে তাঁকে দেখতে পেয়ে জুতো তুলে ছুটে এসেছিলেন অনেকে।
‘‘একজন অভিনেতার জীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে!’’ স্মৃতিচারণে সশ্রদ্ধ হলেন অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ’৪২-এর বছর দশেক পরে ‘মায়ামৃগ’ ছবি। সেখানে বিকাশ রায়ের সঙ্গে প্রথম কাজ করার সুযোগ পান বিশ্বজিৎ। একেবারে নায়কের ভূমিকা। উত্তমকুমার ছিলেন একটি বিশেষ চরিত্রে।
বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘বিকাশদাকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ এর আগে হয়নি। কিন্তু তাঁর ’৪২ দেখে শিহরিত হয়েছিলাম। অভিনয় এমনও হয়!’’ প্রথম দিন পরিচয় করিয়ে দিলেন ছবির পরিচালক চিত্ত বসু। বিকাশবাবু নবাগত নায়ককে বললেন, ‘‘নতুন এসেছ। হিরোর রোল! তুমি তো অভিমন্যু বধ হয়ে যাবে হে!’’ মানে? প্রথমটা বুঝতে পারেননি বিশ্বজিৎ। নিজেই হেঁয়ালি ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন বিকাশ রায়। হেসে বলেছিলেন, ‘‘তোমাকে কাদের পাশে অভিনয় করতে হবে, জানো? ছবি বিশ্বাস, উত্তম, আমি, সন্ধ্যারাণী... সবাই ঘিরে থাকব কিন্তু। তুমি চক্রব্যূহে একা অভিমন্যু। কেউ বেরোনোর জায়গা দেবে না! বেরোতে পারবে তো?’’
’৪২ ছবিতে
‘‘শুনেই কেমন একটা ধাক্কা লেগেছিল,’’ অকপট স্বীকারোক্তি বিশ্বজিতের। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘‘আমাকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য বলছেন নাকি?’’ তার পরেই তিনি বুঝতে পারলেন, বিষয়টা একেবারে উল্টো। আসলে বিকাশবাবু যা বলেছেন, সেটা অগ্রজের উপদেশ। বিশ্বজিতের কথায়, ‘‘সে দিন বিকাশদার বলা কথাগুলো কিন্তু আমাকে সচেতন করে দিয়েছিল। আমি বুঝে নিলাম, পর্দায় টিকে থাকতে হলে নিজের ক্ষমতা উজাড় করে অভিনয়ক্ষমতা দিয়ে নিজেকে চেনাতে হবে। এখন থেকে এটাই হবে আমার ধ্যানজ্ঞান।’’ পরে বিশ্বজিতের পরিচালনায়, প্রযোজনায় একাধিক ছবিও করেছেন বিকাশবাবু।
ছোট-বড় যে চরিত্রই হোক, নিজেকে সেই অনুযায়ী তৈরি করার কাজে বিকাশ রায় কোনও ঘাটতি রাখতেন না। যখন তিনি রীতিমতো নামডাকওয়ালা, তখনও সেই অভ্যেস তিনি ছাড়েননি। শট দেওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চরিত্রায়ন নিয়ে নিজের মতো কিছু না কিছু ভেবেই চলতেন।
অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তী শুনিয়েছেন তেমনই এক টুকরো অভিজ্ঞতা। টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োয় কোনও ছবির শুটিং করছেন তিনি। পাশের ফ্লোরে অন্য কোনও ছবিতে বিকাশ রায়। এক ফাঁকে বাইরে বেরিয়ে লিলিদেবী দেখেন, পুলিশ অফিসারের পোশাক পরা বিকাশবাবু বাইরের চত্বরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। ‘‘কী হয়েছে, বিকাশদা? পায়ে লাগল?’’ তাঁর প্রশ্নে বিকাশ রায় জানিয়েছিলেন, এই পুলিশ অফিসারের চরিত্রে একটু পা টেনে হাঁটলে ভাল হবে মনে হয়েছে বলে তিনি শটের আগে সেটা অভ্যেস করছেন। ফ্লোরে অন্য কেউ কিন্তু তা জানেননি, বোঝেননি। তাঁরা শুধু শটটাই দেখেছেন।
‘আমি সিরাজের বেগম’ ছবিতে মিরজাফর হয়েছিলেন বিকাশবাবু। সিরাজের ভূমিকায় বিশ্বজিৎ। শট দেওয়ার সময় বিশ্বজিতের মনে হত, বিকাশ রায়ের মিরজাফর যেন একটু ভালমানুষ গোছের। চুপচাপ বসে মালা জপছেন, আর ঘাড় হেলিয়ে তাকাচ্ছেন। ক্রূরতার প্রকাশ কি কম হচ্ছে? তখন সংশয় ছিল বিশ্বজিতের। এখন বলেন, ‘‘পরে ছবি দেখে মালুম হল, মিরজাফর চরিত্রকে কী অসীম দক্ষতায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন বিকাশদা। ওই ঠান্ডা দৃষ্টিতে কী অসম্ভব কুটিলতা, ভাবা যায় না!’’
প্রমথেশ বড়ুয়া ছিলেন তাঁর প্রিয় শিল্পী। অভিনয়ে আসার আগেই বড়ুয়া সাহেবের স্টাইল তাঁকে টানত। ফিল্মে পরিমিতি বোধের অনুভূতি তিনি বুঝতে শিখেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবি দেখে। বিকাশ রায়ের কাটা কাটা সংলাপ বলার ভঙ্গিতেও অনেকে তাই বড়ুয়া-স্টাইল খুঁজে পান।
আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ তো শৈশব থেকেই ছিল। তাই প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে যত্ন এবং স্বর প্রক্ষেপণ তাঁর অভিনয় প্রতিভায় যোগ করেছিল বাড়তি মাত্রা। কিন্তু তার বাইরেও আবৃত্তি তাঁকে প্রেরণা দিত। কাজ থেকে ফিরে সময় পেলেই ছেলে সুমিতের সঙ্গে বসে কত কী যে পড়তেন— ‘শেষের কবিতা’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘সঞ্চয়িতা’র পাতা উল্টে কোনও কবিতা। বাবা-ছেলের পাঠে ঘর গমগম করে উঠত।
ইডেনের খেলায় উত্তমকুমারের সঙ্গে
ছেলেকে ডাকতেন ‘বেণুবাবু’ বলে। তবে ছেলে-মেয়ের মুখে সাদামাঠা ‘বাবা’ শুনতে চাইতেন না। তাঁকে সন্তানেরা বলতেন ‘বাবু’। ধমনীতে জমিদারের রক্ত বলেই হয়তো ‘কর্তা’ ডাকটিও অপছন্দের ছিল না।
ছেলেকে নিয়ে এক সান্ধ্য পাঠের আড্ডায় একদিন ঘটল মজার কাণ্ড। সে দিন শেক্সপিয়র-এর লেখা পড়া হবে। বিকাশ রায়ের বাড়ি ছিল বইয়ের গুদাম। পুস্তক অনুরাগী এই অভিনেতার নিজস্ব সংগ্রহে ছিল কয়েক হাজার বই। তাঁর যোধপুর পার্কের ভাড়াবাড়িতে কাজের বাইরে সর্বদা বই নিয়ে মগ্ন থাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন শিল্পী। তাঁর ছেলের কথায়, ‘‘বাবুকে বইয়ের পোকা বলা হত। বাড়ি জুড়ে শুধুই বই, বই, আর বই। কত রকম বিষয়। বিশেষ কোনও বাছবিচার নেই। বই পেলেই তিনি কিনতেন।’’ ছেলেকেও বইয়ের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন পুরোদস্তুর।
কিন্তু সে দিন শেক্সপিয়র পড়তে গিয়ে দেখা গেল, রচনাসমগ্রটি বেপাত্তা! তন্ন তন্ন করে খুঁজে বোঝা গেল, কোনও বহিরাগত অতিথি হয়তো ‘নিজের’ ভেবে সেটি কোনও দিন হস্তগত করেছেন। ‘‘সে হোক। তা-বলে শিক্ষিতের বাড়িতে শেক্সপিয়র থাকবে না! রবীন্দ্রনাথ এবং শেক্সপিয়র যে বাড়িতে নেই, সে বাড়ি বাসের যোগ্যই নয়।’’ মেজাজ হারালেন বিকাশবাবু।
অতএব সিদ্ধান্ত হল, তখুনি শেক্সপিয়রকে বাড়িতে এনে পুনর্স্থাপন করতে হবে। ছেলেকে বললেন, ‘‘বেণুবাবু, গাড়ি বের করো।’’ পুত্র সুমিতবাবুর মনে আছে, তিনি গাড়ি চালিয়ে বাবাকে নিয়ে এলেন চৌরঙ্গির ফারপো হোটেলের কাছে। ফুটপাতের এক পরিচিত বই বিক্রেতা তখন ঝাঁপ ফেলে শোওয়ার আয়োজন করছেন। বই পাওয়া গেল তাঁর ভাণ্ডারে। স্বস্তি পেলেন বিকাশ রায়!
আরও একবার একই ভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ খুঁজে পাননি। পরদিন বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগে কিনতে গিয়ে শুনলেন, ছাপা নেই। আপাতত বাজেট-বরাদ্দও নেই। সুমিতবাবু বলেন, ‘‘বাবু ওঁদের বললেন, আমি যদি গোপনে ছাপার টাকা দিই, তা হলে নেবেন? কাউকে বলতে হবে না। শুধু ছাপলেই হবে।’’ শুনে বিশ্বভারতীর কর্তারা হতবাক!
প্রসঙ্গ শুরু হয়েছিল আবৃত্তির কথা দিয়ে। সেখানেই ফেরা যাক। এখন যে শ্রুতিনাটকের চল, বিকাশবাবু তার অন্যতম সূচনাকার। তাঁর পরিচালনায় ‘শেষের কবিতা’ ছিল প্রথম মঞ্চস্থ শ্রুতিনাটক।
সপরিবার বিকাশ
লিলি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘একদিন স্টুডিয়োয় কাজ করছি। একটু বাইরে বেরোতেই দেখি বিকাশদা। সৌমিত্রদা (চট্টোপাধ্যায়) তখন পাশের ফ্লোরে ঢুকছেন। আমাকে দেখিয়ে বিকাশদাকে বললেন, ‘তুমি লিলিকে ওটা বলেছ?’ বিকাশদা বললেন, ‘এখনই বলব।’ তার পরে ‘শেষের কবিতা’য় আমাকে লাবণ্যর চরিত্র দিলেন। সৌমিত্রদা অমিত। যত্ন করে, ধরে ধরে শিখিয়েছেন বিকাশদা। উত্তর কলকাতায় আমার রাজবল্লভ পাড়ার বাড়িতেও গিয়েছেন বোঝাতে। দারুণ হিট হয়েছিল।’’
চিত্র পরিচালক হিসেবে বিকাশ রায়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। আনুমানিক শ’আড়াই ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। পরিচালনা করেছেন আটটি ছবি। এর মধ্যে পাঁচটি আবার নিজেরই প্রযোজনা। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ তার একটি।
ছবির নায়ক থিরুমলের চরিত্রে উত্তমকুমার। নায়িকা সাবিত্রী ছিলেন কুন্তীর ভূমিকায়। দিঘার কাছে সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে মরুভূমি বানানো হয়েছিল। ছবিতে ব্যবহারের জন্য দু’টি উট এনে রেখেছিলেন। এক চরম নাটকীয় মুহূর্তে মানসিক বিকারগ্রস্ত থিরুমল আচমকা কুন্তীর গলা টিপে ধরবে। সেই দৃশ্য গ্রহণের কয়েক দিন আগে থেকে উত্তমকুমার চুপচাপ। বিশেষ কথা বলছেন না কারও সঙ্গে। কেমন যেন আত্মভোলা ভাব। শুটিং শুরু হল। উত্তমকুমারের দৃষ্টি বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। গলা টিপলেন যখন, তখন যেন তিনি আর নিজের মধ্যে নেই। সাবিত্রীর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শট শেষ করেই ছুটে এলেন পরিচালক বিকাশ রায়। সাবিত্রীর তখন হুঁশ নেই। বমি করে অজ্ঞান। জলটল দিয়ে তাঁকে সুস্থ করে তুলে বিকাশবাবু উত্তমকে ধমক দিলেন, ‘‘তুই তো ন্যাচারাল অ্যাকটিং করতে গিয়ে মেয়েটাকেই মেরে ফেলছিলি!’’ উত্তম বললেন, ‘‘সাবু, প্লিজ ক্ষমা করে দে।’’
ছবির কাজ যখন কমে এল, তখন বেশি বয়সে মঞ্চে গেলেন বিকাশ রায়। সে-ও অনেক সাধ্যসাধনার পরে। তরুণকুমার এবং সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এক রকম জোর করে রাজি করালেন তাঁকে। প্রথম নাটক ‘চৌরঙ্গি’। তিনি স্যাটা বোস। চলচ্চিত্রের দৌলতে উত্তমকুমারের স্যাটা বোস তত দিনে বাজার মাত করেছে। সেই চরিত্রকে মঞ্চে ফোটাতে গোড়ায় খুব আপত্তি ছিল বিকাশবাবুর। বলেছিলেন, ‘‘উত্তমকে পর্দায় দেখার পরে আমাকে দর্শক নেবেই না।’’ উত্তম তা শুনে বলেছিলেন, ‘‘তুমি নিজেকে এত কম ভাবছ কেন? আমি জানি, তুমি নিজের মতো করে চরিত্র ফোটাবে। আমি দেখতে যাব।’’ বিকাশবাবু উত্তরে বলেন, ‘‘দর্শক আসনে তোকে দেখলে আরও নার্ভাস হয়ে যাব রে!’’ উত্তমকুমার গিয়েছিলেন। না জানিয়ে অন্ধকারে হলে ঢুকে বসে পড়েছিলেন। পরে গ্রিনরুমে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাঁর বিকাশদাকে। এর পরেও আরও কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন বিকাশ রায়। প্রায় সবই তরুণকুমার, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে।
কাজের জগতের বাইরে বিকাশ রায় ছিলেন একেবারেই পারিবারিক। স্বামী, বাবা, গৃহকর্তা ঠিক যেমনটি হন। তাঁর ছেলের কাছে শুনেছি, ওঁদের বাড়িতে ফিল্ম নিয়ে আলোচনা কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। বাবার সহকর্মী বন্ধুদের আর পাঁচ জনের মতোই কাকা, জেঠু বলে সম্বোধন করতে হত। উত্তমকাকা, ভানুকাকা (বন্দ্যোপাধ্যায়), পাহাড়িজেঠু (সান্যাল), হেমন্তকাকা (মুখোপাধ্যায়), বসন্তকাকা (চৌধুরী) ইত্যাদি। তাঁরা কাজের সূত্রে বাড়িতেও আসতেন। কিন্তু সৌজন্যের বাইরে সেখানে ছোটদের প্রবেশাধিকার ছিল না।
বিকাশবাবুর বইয়ের প্রকাশক বামাচরণবাবু বলেছেন, তিনি বছর দশেক প্রায় নিয়মিত বিকাশ রায়ের যোধপুর পার্কের বাড়িতে যাতায়াত করলেও সিনেমার লোকজনকে বড় একটা দেখেননি। দেখেছেন এক নিপাট সাদামাঠা গৃহস্থ বিকাশবাবুকে। ছেলে দীর্ঘ দিন বিদেশে। মেয়ে বিবাহিত (পরে মারাও যান)। বাড়িতে সেই সময় শুধু স্ত্রী আর তিনি। কাজ না থাকলে তাঁর একমাত্র বিনোদন ছিল বই এবং গান শোনা।
সিগারেট খেতেন। বিদেশি গাড়ির শৌখিনতা ছিল। আর হয়তো বংশের ধারায় কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি পরতে পছন্দ করতেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনচর্যায় অন্য কোনও উচ্ছ্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি।
পড়ায় মগ্ন
আমেরিকা থেকে তাঁর ছেলে সুমিতবাবু জানিয়েছেন, ‘‘দেশ ছাড়ার আগে পর্যন্ত আমরা সাধারণত একসঙ্গে রাতের খাওয়া সারতাম। নিয়মটা বাবুই চালু করেছিলেন। তখন খাওয়ার টেবিলে বাবু, মা, আমি, বোন সবাই মিলে কথা হত। সারা দিন কে কী করলাম তা নিয়ে আলোচনা হত। বাবু লেখাপড়ার খোঁজ নিতেন।’’
হাঁপানির প্রকোপে গলার স্বর যখন ভেঙে গেল, তখন নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন— আর নয়। এ বার সরে দাঁড়াতে হবে। স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‘যা দিতে চাই, তা দিতে পারব না। মানুষ যা চাইবে, পাবে না। এই অবস্থায় কাজ করলে দর্শকের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করা হবে। সেটা সইবে না।’’
ছেলে চেয়েছিলেন, বাবা-মা তাঁর কাছে আমেরিকায় গিয়ে থাকুন। যাননি। নিজের শহর, চেনা পরিমণ্ডল তাঁকে পিছু টেনে ধরেছে। শেষ জীবনে তাঁর ৪৩১, যোধপুর পার্কের ভাড়াবাড়ির রাস্তার দিকের বারান্দায় আরামকেদারায় বসে চলমান জীবন দেখতেন। বই পড়তেন, অথবা আত্মমগ্ন হয়ে ভাবতেন। কোনও দিন কোনও অভিযোগ ছিল না। চাহিদাও ব্যক্ত করেননি। জীবনের পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে নীরবই থেকেছেন।
কারও হয়তো মনে পড়তে পারে ‘বনপলাশীর পদাবলি’ ছবির সেই দৃশ্য। কর্মজীবনের শেষে আপন ঘরে ফিরে জগৎ ও জীবনকে যেন নতুন করে চিনলেন শিক্ষক গিরিজাপ্রসাদ। বড় বেদনার সেই অনুভব। ভাঙা মনে, ক্লান্ত পায়ে হেঁটে আসছেন তিনি। নেপথ্যে ভেসে আসছে সংগীত— ‘সাথীহারার গোপন ব্যথা, বলব যারে সে জন কোথা...’
১৯৮৭ সালে জীবনাবসান হয় বিকাশ রায়ের। বয়স তখন ৭১।
সহায়তা: ‘কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’। বিকাশ রায়