শশধর মুখোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
কথা ছিল বিলেতে গিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবেন। ‘আইসিএস’, ‘ব্যারিস্টার’ বা ওই রকম কিছু হয়ে ফিরবেন দেশে। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এম এ পাশ করে, পঁচিশ বছরের তরতাজা সেই যুবক ঝাঁসিতে ফিরে একটি কলেজে শিক্ষকতার কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরিবারের সকলেই আইনজ্ঞ হওয়ায় তাঁর ইচ্ছে হয় তিনি লন্ডনে গিয়ে আইন পরীক্ষা দিয়ে দেশে ফিরে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবেন। বাবা মায়েরও ইচ্ছে ছিল ছেলে আইন পড়ে বিচারপতি হোক। যুবক তাই উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি শহর থেকে এসে পৌঁছলেন মুম্বই শহরে, বিলেতে যাওয়ার জাহাজে উঠবেন বলে। সঙ্গে তাঁর শ্যালক। জামাইবাবুকে মুম্বই বন্দর থেকে জাহাজে তুলে দিয়ে ফিরে যাবেন, হয়তো এমনই পরিকল্পনা ছিল তাঁদের।
কিন্তু কী ভাবে যেন হঠাৎই দেখা হয়ে গেল মুম্বইয়ের এক বিলেতফেরত সফল চলচ্চিত্র প্রযোজক ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। সেই প্রযোজকও একদিন একই ভাবে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে আইসিএস হতে। কিন্তু ফিরে এসেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগের আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া এক পরিচালক ও প্রযোজক হয়ে। তিনি তখন মুম্বইয়ের মালাড অঞ্চলে সদ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন বিরাট এক সিনেমা স্টুডিয়ো, যেখানে তৈরি হয়েছে সবাক যুগের প্রথম অত্যাধুনিক ‘সাউন্ড স্টেজ’। নাম দিয়েছেন, ‘বম্বে টকিজ়’। স্বামী-স্ত্রীতে মিলে তাঁদের যৌথ এক স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছেন। এমনই এক সময়ে পঁচিশ বছরের তরতাজা ওই যুবককে তাঁরা আহ্বান করলেন বিলেতে গিয়ে আইনজ্ঞ না হয়ে তাঁদের বম্বে টকিজ় স্টুডিয়োতে যোগ দিতে। সঙ্গী শ্যালক সহ।
যুবকটির আর বিলেত যাওয়া হল না। ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তাঁর আইনজ্ঞ পিতা হরিপদ মুখোপাধ্যায়। ছেলে বিলেত না গিয়ে সিনেমার স্টুডিয়োয় চাকরি করবে এমন উদ্ভট সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি সঙ্গত কারণেই। ১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসে যুবকটি বম্বে টকিজ় স্টুডিয়োয় একজন সহকারী শব্দগ্রাহক হয়ে কাজে যোগ দিলেন। শ্যালক যুক্ত হলেন স্টুডিয়োর ল্যাবরেটরিতে সহকারী হিসেবে। বিখ্যাত সেই প্রযোজক হলেন হিমাংশু রাই, আর তাঁর স্ত্রী দেবিকারানি। যুবকটি শশধর মুখোপাধ্যায় আর শ্যালক অভিনেতা অশোককুমার। বলা যেতে পারে, এই চার বাঙালির হাত ধরেই আজকের মুম্বইয়ের বলিউড চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির গোড়াপত্তন হয়েছিল। ইতিহাস এই ভাবেই বোধহয় তৈরি হয়।
১৯৩৩ সাল ছিল ভারতীয় চলচ্চিত্রের নির্বাক থেকে সবাক যুগে পা দেওয়ার বছর। এত দিন সিনেমা তৈরি করতে কোনও শব্দগ্রাহক বা সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু সবাক যুগে সেই প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। মনে রাখা দরকার, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের কাজ দক্ষ ভাবে করতে পারেন তিনিই, যিনি পদার্থবিজ্ঞানে পারদর্শী। তখনকার সব স্টুডিয়ো তাই এই পদার্থবিজ্ঞানীদেরই খোঁজ করছিল। নিউ থিয়েটার্স, প্রভাত ও বম্বে টকিজ় সেই সময়ের প্রধান তিনটি স্টুডিয়ো, যারা সর্বভারতীয় স্তরে ছবি তৈরি করত। সকলকেই এমনটা করতে হয়েছিল। প্রসঙ্গত, পরিচালক তপন সিংহও ছিলেন এমনই একজন পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯৪৫ সালে তিনিও নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োর সঙ্গে যুক্ত হন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। তাই পদার্থবিজ্ঞানে এম এ পাশ করা কৃতী ছাত্র শশধরকে পেয়ে হিমাংশু রাই যেন চাঁদ হাতে পেয়েছিলেন। তিনি তাই তাঁর স্টুডিয়োয় শশধরকে যোগ দিতে রাজি করান সহকারী সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। হিমাংশু রাইয়ের এই সিদ্ধান্ত পরবর্তী কালে জন্ম দিয়েছিল এক আশ্চর্য প্রযোজকের, যিনি সবাক ভারতীয় সিনেমাকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
তবে শশধর মুখোপাধ্যায় কে ছিলেন তা আজ হয়তো অনেকেই জানেন না। তাঁর জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯০৯ উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি শহরে। ঝাঁসির এই প্রবাসী বাঙালি পরিবারের আদি নিবাস ছিল তারকেশ্বরের কাছে পুরশুঁড়া জেলার মাথামোড়া গ্রামে। বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়। মা লীলাবতী দেবী। তাঁদের তিন সন্তান শশধর, সুবোধ ও প্রবোধ। মুখোপাধ্যায় পরিবারের সঙ্গে চলচ্চিত্রের কোনও যোগাযোগ কখনওই ছিল না। শশধর নিজেও চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহ দেখাননি।
শোনা যায়, হরিপদবাবু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের ডিগ্রি লাভ করেন। একবার তিনি একটি বিশেষ মামলা লড়ার জন্য হাওড়া থেকে মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া যাচ্ছিলেন। মাঝপথে ঝাঁসি রেলস্টেশনে তিনি চা খেতে নেমেছিলেন। গায়ে ছিল উকিলের কোট। স্টেশনে তাঁকে উকিল হিসেবে চিনতে পেরে একজন মক্কেল তাঁর হয়ে মামলা লড়ার জন্য অনুরোধ করেন। হরিপদ সেই অনুরোধ রক্ষা করতে মামলা লড়েন এবং জিতেও যান। এই কারণে ঝাঁসিতে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং তখন থেকেই তিনি ঝাঁসির বাসিন্দা হয়ে যান।
মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ায় প্রচুর প্রবাসী বাঙালির বসবাস। সেখানকার এক প্রবাসী বাঙালি আইনজীবী পরিবারের মানুষ ছিলেন কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি অশোককুমার, কিশোরকুমার, সতীরানি দেবীর বাবা। এই সতীরানি দেবীর সঙ্গে পরবর্তীকালে শশধর মুখোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়। তাঁদের পাঁচ পুত্র। জয়, রণ, সোমু, দেব, সুবীর। একমাত্র কন্যা শিবানী। আজকের বলিউড সিনেমার তনুজা, কাজল ও রানি (মুখোপাধ্যায়) হরিপদর পরিবারেরই পরবর্তী প্রজন্ম। কিন্তু মানুষের জীবনের বিচিত্র গতিপথ তাঁকে ও তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে এসেছিল চলচ্চিত্র দুনিয়ায়। শশধরের দুই ভাই সুবোধ ও প্রবোধও চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
শশধর মুখোপাধ্যায়ের মা লীলাবতী দেবী হলেন হরিপদ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম স্ত্রী। তিনি অসময়ে মারা যাওয়ায় হরিপদ যে দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তাঁদের কোনও সন্তান ছিল না। কিন্তু তৃতীয় স্ত্রীর ছেলে রবীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির যোগাযোগ ছিল। তিনি হিন্দি ছবি প্রযোজনাও করেছিলেন। অর্থাৎ শশধরের সৎ দাদা হলেন রবীন্দ্রমোহন। রবীন্দ্রমোহনের ছেলেই হলেন রাম মুখোপাধ্যায়। রাম মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে রানি।
শশধর শুধু একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক ছিলেন বললে সবটা বলা হয় না। আজ প্রযোজক বলতে আমরা যা বুঝি শশধর একেবারেই তা ছিলেন না। এ দেশে চলচ্চিত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রথমে ব্রিটিশ ও পরে হলিউডের সিনেমার বিশেষ প্রভাব আছে। আজ আমরা প্রযোজক বলতে বুঝি এমন একজন মানুষ, যিনি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অর্থ লগ্নি করেন। হলিউডের ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রযোজকরা কিন্তু তেমন কেউ নন। প্রযোজকদের কাজ ছিল স্টুডিয়ো যে ছবি করতে খরচ করছে সেই ছবির যাবতীয় ব্যবস্থা (পরিকল্পনা) করা, ছবির চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক থেকে কলাকুশলী যাঁরা হবেন তাঁদের জোগাড় করা এবং ছবির অভিনেতা অভিনেত্রী নির্বাচন করা। তিনিই হচ্ছেন শেষ কথা। তাঁর অনুমতি বা সম্মতি ছাড়া কিছু হওয়ার নয়। ছবির সাফল্য, ব্যর্থতা নির্ভর করত তাঁর বিচক্ষণতার উপরে।
হলিউডের চলচ্চিত্র জগতে এমন অনেক কিংবদন্তি প্রযোজকের দেখা পাওয়া গিয়েছে, যাঁরা তাঁদের বুদ্ধি বিবেচনাকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যসফল চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন, তেমনই আবার জন্ম দিয়েছেন সফল পরিচালক থেকে অভিনেতা অভিনেত্রীদের। ভারতীয় ছবিতে সফল ভাবে সেই কাজটি প্রথম করেছিলেন শশধর মুখোপাধ্যায়। যেটা লক্ষ্য করার মতো, এই কাজ করতে গিয়ে হলিউড বা বলিউডের অনেক প্রবাদপ্রতিম প্রযোজক খ্যাতি লাভ করেছেন। কিন্তু শশধর মুখোপাধ্যায় একটার পর একটা বাণিজ্যসফল ছবি প্রযোজনা করে গেলেও কেউ তাঁকে দেখা তো দূরের কথা, চিনতও না। তিনি নিজেকে আড়ালে রাখতেই পছন্দ করতেন।
১৯৩৫ সালে বম্বে টকিজ়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ১৯৩৯ সাল অবধি তিনি শব্দগ্রাহকের কাজ করে গিয়েছেন। মাঝে হিমাংশু রাইয়ের সঙ্গে চিত্রনাট্যর ব্যাপারে কিছু কিছু মতামত বিনিময় হয়েছে। কিন্তু ক্রমশ তিনি স্টুডিয়োর নানা কাজে নিঃশব্দে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছিলেন। হিমাংশু-দেবিকার মধ্যে দাম্পত্য কলহ মেটাতে প্রেমিক ও ‘জীবন নইয়া’ ছবির নায়ক নাজম-উল-হাসানের সঙ্গে পলায়মান দেবিকা রানিকে বুঝিয়েসুঝিয়ে কলকাতা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে হিমাংশু রাইয়ের আস্থাভাজন হয়েছিলেন। তবে এই ঘটনার অভিঘাতে ‘জীবন নইয়া’ ছবির শুটিং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ ছবির নায়ক নাজম-উল-হাসানের পক্ষে বম্বে টকিজ়ের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখা সম্ভব ছিল না। তাই প্রয়োজন পড়েছিল একজন নায়কের।
বম্বে টকিজ় একটি নতুন স্টুডিয়ো হওয়ায় তখনও অবধি তাদের কাছে কলকাতার নিউ থিয়েটার্স বা পুণের প্রভাত স্টুডিয়োর মতো জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংগ্রহ ছিল না। তাই তাদের নির্ভর করতে হত নতুন প্রতিভাবান শিল্পী খুঁজে এনে তাঁদের দিয়ে ছবি তৈরি করতে। এমন অবস্থায় শশধরকে দেখা যাচ্ছে সক্রিয় হয়ে নিজের শ্যালক ও পরবর্তীকালের বিখ্যাত অভিনেতা অশোককুমারের নাম প্রস্তাব করতে। অশোককুমার জানিয়েছেন, “তখন বম্বে টকিজ় নায়িকাপ্রধান ছবি করত মালিকের স্ত্রী দেবিকা রানির কারণে। আমি স্টুডিয়োর ল্যাবরেটরিতে কাজ করতাম। শশধর মুখার্জি দায়িত্ব নেওয়ার পর একদিন আমাকে ডেকে বলেন তোমাকে আমি অভিনেতা বানাব।” ‘জীবন নইয়া’ ছবিতে অশোককুমারের নায়ক হিসেবে আবির্ভাব এই ভাবেই সম্ভব হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে ‘জীবন নইয়া’র সঙ্গেই আরও তিনটি ছবি, ‘অচ্ছুৎ কন্যা’, ‘জন্মভূমি’, ‘মমতা অওর মিয়াঁবিবি’ মুক্তি পায় এবং এর মধ্যে ‘অচ্ছুৎ কন্যা’ বম্বে টকিজ়ের মাইলফলক ছবি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকলেও জনপ্রিয় বা হিট ছবি ছিল না।
এর থেকে প্রমাণ হয় ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ সালের ‘কঙ্গন’ অবধি চার বছরে বম্বে টকিজ় থেকে যে ১৪টি চলচ্চিত্র তৈরি হয়, সেখানে নেপথ্যে থেকে নীরবে প্রযোজকের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছিলেন শশধর। কিন্তু একমাত্র ‘কঙ্গন’ ছবি ছাড়া তার আগের ১৩টি ছবিতে প্রযোজক হিসেবে তাঁর নাম নথিভুক্ত করা নেই। ‘কঙ্গন’ ছবিতে যে তাঁর নাম নথিভুক্ত হয়েছিল, তার পিছনেও এক ঐতিহাসিক ঘটনা যুক্ত হয়ে আছে। ঠিক যেমন শশধরের বম্বে টকিজ়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পিছনে ছিল ভারতীয় সিনেমার নির্বাক থেকে সবাক যুগের প্রবেশের সন্ধিক্ষণ। এ বার সেটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সময়টা ১৯৩৯ সাল।
শশধর যে দেবিকা রানিকে কলকাতা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারপর হিমাংশু, দেবিকা ও তাঁর মধ্যে সুন্দর এক সখ্য যেমন গড়ে ওঠে তেমনই, দেবিকা ও হিমাংশুর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। দেবিকার বিচিত্র স্বভাবকে সামলাতে হিমাংশু হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। শরীরে ও মনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমনই এক সময় বেজে ওঠে বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যার অভিঘাত সরাসরি এসে পড়ে বম্বে টকিজ় স্টুডিয়োর উপর।
হিমাংশু রাই বম্বে টকিজ় তৈরির সময় জার্মানি থেকে দক্ষ কলাকুশলীদের নিয়ে এসেছিলেন। পরিচালক থেকে চিত্রগ্রাহক, শব্দগ্রাহক এবং আরও যাঁরা প্রধান কলাকুশলী ছিলেন সকলেই এসেছিলেন জার্মানি থেকে। এঁরাই বম্বে টকিজ়ের ছবির দেখাশোনা করতেন। তাই তাঁদের ছবির গুণগত ও প্রযুক্তিগত মান ছিল খুবই উন্নত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সারা বিশ্ব দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি। মিত্রশক্তির ব্রিটিশ ভারতে অক্ষশক্তির জার্মানির নাগরিকদের তারা সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। ফলে বম্বে টকিজ়ের জার্মানি থেকে আসা কলাকুশলীরা আর ভারতে থাকাটা নিরাপদ মনে করেন না। তল্পিতল্পা গুটিয়ে তাঁরা পাড়ি দেন নিজের দেশে। হিমাংশু রাইয়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকেন ভারতীয় কর্মীদের দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করতে। এরই ফলে বম্বে টকিজ়ের ছবি প্রযোজনার ক্ষেত্রে শশধর সামনের সারিতে চলে আসেন। ১৯৩৯ সালের ‘কঙ্গন’ ছবিতে শশধর মুখোপাধ্যায়ের নাম প্রযোজক হিসেবে প্রথম নথিভুক্ত হতে দেখা যায়। যদিও সেই ছবির পরিচালক জার্মানির বিখ্যাত পরিচালক ফ্রান্স অসটেন। তবু বম্বে টকিজ়কে বাঁচাতে পারেননি হিমাংশু রাই। হতাশায়, উদ্বেগে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হিমাংশুর মৃত্যু ঘটে ১৬ মে ১৯৪০ সালে, মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে।
এই মৃত্যু বম্বে টকিজ়ের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করেছিল। কর্মীরা স্টুডিয়ো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় দিন গুনতে শুরু করেছিলেন। স্টুডিয়োর অনেক দেনাও জমে গিয়েছিল। এমনই এক সময় শশধরকে স্টুডিয়োর হাল ধরতে স্টুডিয়োর বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের তরফে রিচার্ড টেম্পল অনুরোধ করেন। দেবিকা রানিও আপত্তি করেননি। ঠিক হয় স্টুডিয়োর অর্থনৈতিক হাল ফেরাতে শশধর পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে এমন একটি ছবি তৈরি করবেন, যা আর্থিক ভাবে সফল হবে।
শশধর জানিয়েছেন, “আমাকে উদয়-অস্ত কাজ করতে হয়েছিল। সবাইকে সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়তে হয়েছিল। গোটা ইউনিটকে আমি ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিলাম। ‘বন্ধন’ ছবিটি সম্পূর্ণ করতে গল্প বাছাই, চিত্রনাট্য লেখা থেকে শেষ শটটি নেওয়া অবধি আমাদের দু’মাস দশ দিন সময় লেগেছিল।” ইতিহাস সাক্ষী এন আর আচার্য পরিচালিত, অশোককুমার ও লীলা চিটনিস অভিনীত ‘বন্ধন’ বক্স অফিসে বিরাট সাফল্য পেয়েছিল। বম্বে টকিজ় তার সমস্ত আর্থিক দায় থেকে মুক্ত হয়েছিল। এমনকী কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের বোনাসও দিয়েছিলেন।
এর পরই শশধর একজন ‘আশ্চর্য সফল’ প্রযোজক হিসেবে হিন্দি সিনেমার আকাশে আবির্ভূত হলেন। তিনি জানিয়েছেন, হলিউডের সিনেমা, বিশেষ করে আর্নস্ট লুবিশ্চ ও ফ্র্যাঙ্ক ক্যাপরার ছবির বিরাট প্রভাব তাঁর উপর পড়েছিল। হিন্দি সিনেমার বিশেষজ্ঞদের মতে শশধরের কাজের উপর হলিউডের এই প্রভাবের চিহ্ন রয়ে গিয়েছে তাঁর প্রযোজনার পরবর্তী কয়েকটি ছবির মধ্যে যেমন, ‘নয়া সংসার’, ‘ঝুলা’ ও ‘কিসমত’। প্রসঙ্গত ‘কিসমত’ একটি কালজয়ী ছবি। এই ছবি সারা ভারতে টানা এক বছর ও কলকাতার রক্সি হলে টানা তিন বছর চলেছিল। এই রেকর্ড আজ অবধি অন্য কোনও ছবি ভাঙতে পারেনি। এই ছবির পরই শশধর বম্বে টকিজ় ছেড়ে ১৯৪৩ সালে রায়বাহাদুর চুণীলাল, অশোককুমার ও জ্ঞান মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘ফিল্মিস্তান’ তৈরি করেন। ১৯৫০ সালে তাঁর বড়দা রবীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তৈরি করেন নিজেদের পারিবারিক স্টুডিয়ো ‘ফিল্মালয়’। ফিল্মালয়ে একটি অভিনয় শেখানোর স্কুলও তিনি বানিয়েছিলেন। অভিনেতা সঞ্জীবকুমার এই স্কুলেরই একজন ছাত্র। বম্বে টকিজ় থেকে ফিল্মালয় অবধি কতগুলি ছবি শশধর প্রযোজনা করেছেন তার ঠিক সংখ্যা বলা কঠিন। তবে বাণিজ্যিক ছবি তৈরি করলেও তাঁর মন পড়ে থাকত ছবি তৈরির আনন্দের দিকে। তাঁর কথায়, “আমি কেবল ছবি তৈরিতে মজে থাকতাম। বাকিরা সে সব ছবি থেকে পয়সা বানানোর কথা ভাবত।” এমন কথা আজ আমরা পরিচালকদের মুখ থেকে শুনেই অভ্যস্ত, কোনও প্রযোজকের থেকে নয়।
তবে যতগুলি ছবি তিনি প্রযোজনা করেছেন সেগুলির নেপথ্যের জাদুকর ছিলেন তিনি। তাঁকে সে ভাবে কেউ দেখতে পেত না। নিজের অফিস ঘরে বসে কাগজে কলমে তিনি ছবির যাবতীয় পরিকল্পনা নিখুঁত ভাবে করে দিতেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হত। তাঁর এই পরিকল্পনাই জন্ম দিয়েছিল ‘আনারকলি’, ‘নাগিন’, ‘তুমসা নেহি দেখা’, ‘মুনিমজি’ ও ‘পেয়িং গেস্ট’-এর মতো অবিস্মরণীয় ছবিগুলির।
সঙ্গীত সম্পর্কে শশধরের তেমন কোনও জ্ঞান ছিল না। কিন্তু গানের সুর শুনে বলে দিতে পারতেন সেই সুরে তৈরি গান দর্শকের দরবারে জনপ্রিয়তা পাবে কিনা। ‘আনারকলি’ ছবিতে বসন্ত প্রকাশের সুর দেওয়া ‘আ জানে ওয়াফা’ গানটি ছবির জন্য নির্বাচন করেন শশধর। গানটি দারুণ জনপ্রিয়ও হয়। ‘আনারকলি’র এই গানটি সুর দেওয়ার পর বসন্ত প্রকাশ মারা যান। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় সি রামচন্দ্রকে। তিনি শর্ত দেন, ছবির সব ক’টি গানই গাইবেন লতা মঙ্গেশকর। কিন্তু শশধর মুখোপাধ্যায়ের আদেশে গীতা দত্তের গাওয়া এই গানটিকে রেখে দেওয়া হয়।
আবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘শর্ত’ (১৯৫৪) ছবির জন্য আটটি গান তৈরি করে এনে শশধরকে তাঁর অফিসে বসে শুনিয়েছিলেন। আটটির মধ্যে যে গানটি শ্রোতাদের সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল, সেই গানটিই তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে রেকর্ড করতে বলেন। হেমন্ত নিজেও গানটির পক্ষে ছিলেন না। তাঁর মনে হয়েছিল, এই গানটির চেয়ে অনেক সুন্দর সুরের গান তিনি এনেছেন। কিন্তু শশধর তাঁর মত বদল করেননি। দেখা গেল, শশধরের নির্বাচিত গানটি সুপারহিট হয়েছে। ‘না ইয়ে চাঁদ হোগা/না তারে রহেঙ্গে/মগর হম হামেশা তুমহারে রহেঙ্গে’। ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও গীতা দত্ত দু’জনেই এই গানটি গেয়েছিলেন। গানটি আজও আমাদের মনকে আন্দোলিত করে। শ্যামা, দীপক ও শশীকলা অভিনীত ‘শর্ত’ ছবির পরিচালক বিভূতি মিত্র।
তবে শশধরের সামনে যে বিরাট অসুবিধেটা ছিল সে সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, “আমরা অন্য ফিল্ম কোম্পানির ছবি দেখতাম। আমরা জানতাম আমাদের কাছে নিউ থিয়েটার্সের কে এল সাইগল বা কাননদেবী নেই। প্রভাত স্টুডিয়োর শান্তা আপ্তেও নেই। তাই আমাদের সব কিছু নিয়েই আমাদের মতো করে ভাবতে হয়েছিল। সহজ সুর, সহজ গল্প। সেই সঙ্গে খুঁজতে হয়েছিল নতুন গল্পকার, তৈরি করতে হয়েছিল নতুন তারকাদের।”
আরও একটা কথা চালু আছে মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র মহলে। হিন্দি সিনেমার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন শশধর ভারতীয় বাণিজ্যিক সিনেমায় ‘ফর্মুলা তত্ত্ব’র প্রচলন করেছিলেন। অর্থাৎ যদি কোনও ছবি বক্স অফিসে সফল হয়, তখন বুঝতে হবে ছবির গল্পটি দর্শকের মনে ধরেছে। তখন অনিশ্চিত লগ্নির সিনেমা শিল্পে সেই ছবির গল্পের আদলে আরও ছবি করা শুরু হয়ে যায় সাফল্যর মুখ দেখার আশায়। হয়েছেও তাই। ফর্মুলা ছবি বানানোর রীতি রেওয়াজ আজও রয়ে গিয়েছে যেমন হিন্দি সিনেমায়, তেমনই বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার বাণিজ্যিক ছবির জগতে।
আবার, শশধর আশ্চর্য সব সফল ছবি বানাতে গিয়ে তৈরি করে ফেলেছিলেন বিভিন্ন গুণী শিল্পীকে। যাঁরা পরবর্তী কালে ভারতীয় সিনেমার উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন। যেমন চিত্রনাট্যকার হিসেবে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাদাত হাসান মান্টো। পরিচালক জ্ঞান মুখোপাধ্যায় (মুখার্জি), নীতিন বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিমল রায়। শিল্প নির্দেশক চারু রায়। নায়ক অশোককুমার, দিলীপকুমার, শাম্মি কপূর, দেব আনন্দ। সঙ্গীতকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গায়ক কিশোরকুমার-সহ আরও অনেক দিকপাল শিল্পী গড়ে দিয়েছিলেন শশধর মুখোপাধ্যায়, যাঁরা পরবর্তী কালে ভারতীয় হিন্দি সিনেমার দর্শককে মাতিয়ে রেখেছিলেন নানা ভাবে।
১৯৯০ সালের ৩ ডিসেম্বর চলে গিয়েছিলেন শশধর। নিজে সারাজীবন থেকেছেন আড়ালে। আজ বলিউডের প্রভাবশালী কপূর, চোপড়া, সমর্থ, জোহর, বচ্চন, খান বা ভট্ট পরিবারগুলির মধ্যে একমাত্র বাঙালি ‘মুখার্জি পরিবার’। যাঁদের আদিপুরুষ হলেন নেপথ্যচারী এক জাদুকর প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়।