দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার।
বেঙ্গমা: আচ্ছা, এই হ্যারি পটার ব্যাপারটা কী?
বেঙ্গমী: ছোটদের খুব পছন্দের চরিত্র। বই-সিনেমা... সব আছে।
বেঙ্গমা: ওরা লালকমল-নীলকমল পড়ে না?
বেঙ্গমী: ওরা টিভিতে শিনচ্যান, ডোরেমন আরও কত কী দেখে...
বেঙ্গমা: তা কচিকাঁচারা এখন গল্পের বই পড়ে?
বেঙ্গমী: অত সময় কোথায়? স্কুল, টিউশন, এক্সট্রা ক্যারিকুলারের পরে ট্যাব নয় টিভিতে কার্টুন দেখে।
আজ বেঙ্গমা-বেঙ্গমী থাকলে এমন কথন কি খুব স্বাভাবিক হত না? ‘সুখু দুখু’, ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’, ‘লালকমল নীলকমল’, ‘টুনটুনি’, ‘মজন্তালি সরকার’... বাংলা রূপকথার সাম্রাজ্যে অজস্র মণিমুক্তো। সিন্ডারেলা, অ্যালিসের সঙ্গে অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছিল আমাদের কিরণমালা। সেই সব রূপকথা পড়ে শিশুমন কল্পনার পক্ষীরাজে চড়ে পাড়ি দিত। এর সিংহভাগ কৃতিত্বই কিন্তু বাংলা রূপকথার জনক দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের। অনেকের অভিযোগ, এখনকার কচিকাঁচারা বই কিনে আঁকড়ে ধরে গন্ধ নেয় না আর। কিন্তু আজও ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ দশ হাজারের বেশি কপি ছাপা হয়।
যে সময়টায় দক্ষিণারঞ্জন লিখতে শুরু করেছিলেন, তখন হ্যানসেল অ্যান্ড গ্রেটেল, গ্রীমভাইদের রূপকথা বা রুশদেশের উপকথা সদর্প বিরাজমান। কিন্তু দক্ষিণারঞ্জন এলেন, দেখলেন, জয় করে নিলেন বাংলার মন। ছোটদের দুপুরগুলো দখল করে নিল বুদ্ধু ভূতুম, চাঁদের বুড়ি। গ্রাম বাংলা চষে সোঁদা মাটির গন্ধ লাগা গল্পগুলি তুলে এনেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন।
ভূমিকা লিখে দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ
যেমন ভাবে মা-পিসির কাছে গল্প শুনতেন, তেমনই ঝরঝরে ভাষায় লিখতেন দক্ষিণারঞ্জন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দেশের শিশুরা কোন পাপে আনন্দের রস হইতে বঞ্চিত হইল?— মাতৃদুগ্ধ একেবারে ছাড়াইয়া লইয়া কেবলই ছোলার ছাতু খাওয়াইয়া মানুষ করিলে ছেলে কি বাঁচে?— কেবল বইয়ের কথা! দেশলক্ষ্মীর বুকের কথা কোথায়?— বাংলার ছেলে যখন রূপকথা শোনে, সমস্ত বাংলাদেশে চিরন্তন স্নেহের সুরটি তাহার চিত্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহাকে যেন বাংলার রসে রসাইয়া লয়।’ দক্ষিণারঞ্জনের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ কবিগুরুর আক্ষেপ মিটিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন।
১৮৭৭ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকার উলাইল গ্রামে মিত্রমজুমদার বংশে দক্ষিণারঞ্জনের জন্ম হয়। বারো ভুইয়াঁর সঙ্গে লেখকের পারিবারিক যোগ রয়েছে। অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান ছিলেন। গল্পের চাবিকাঠিও তাঁর পরিবার-সূত্রেই পাওয়া। দুরন্ত ছেলেকে শান্ত করার জন্য কুসুমকুমারী দেবী রূপকথার গল্প শোনাতেন। সাতসমুদ্র পেরিয়ে হারিয়ে যেত তাঁর মন। কিন্তু নিশ্চিন্তের জীবনে হঠাৎই বিপর্যয়। মারা গেলেন কুসুমকুমারী। মাতৃহারা দক্ষিণারঞ্জনকে নিয়ে রমদারঞ্জন পড়লেন ঘোর বিপাকে। হাল ধরলেন তাঁর পিসি রাজলক্ষ্মী দেবী। মা যেমন ভাবে গল্প শোনাতেন, ঠিক তেমন ভাবে পিসিও তাঁকে গল্প শোনাতেন।
কি হইল কন্যা, মতির ফুল?— লেখকের নিজের আঁকা
যে ব্যক্তির হাত দিয়ে এত সরস লেখা বেরিয়েছে, তিনি কিন্তু পড়াশোনায় মোটেও ভাল ছিলেন না। অনেক বার স্কুল বদলেছেন। কোনও মতে কলেজ শেষ করেন। একটা সময়ে ঢাকা থেকে রমদারঞ্জন চলে আসেন মুর্শিদাবাদে। দক্ষিণারঞ্জনও বাবার সঙ্গে এসে সেখানকার স্কুলে ভর্তি হন। কলেজও বহরমপুরেই। প্রথাগত শিক্ষায় অনীহা থাকলেও সাহিত্যচর্চায় তুমুল আগ্রহ ছিল দক্ষিণারঞ্জনের। স্কুলের বোর্ডিংয়ে লুকিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা পড়ার জন্য শাস্তি পেয়েছিলেন। রমদারঞ্জনও গ্রন্থপ্রেমী ছিলেন। অতি উৎসাহে বাবার বইয়ের ভাণ্ডারে নিমজ্জিত হন দক্ষিণারঞ্জন। পাঠ্যপুস্তকে যাঁর আগ্রহ ছিল না, সেই মানুষই ২৫ বছর বয়সে ‘উত্থান’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন।
দক্ষিণারঞ্জনের প্রতিটি সৃষ্টির পিছনে আলাদা গল্প রয়েছে। পিসি রাজলক্ষ্মী দেবী জমিদারি পরিদর্শনের ভার দিয়েছিলেন ভাইপোর উপরে। গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে এসে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার, গল্পের ঝুলি পূর্ণ হয়ে ওঠে। গীতিকথা, রূপকথা, লোককথা, ব্রতকথা— কিচ্ছুটি বাদ দেননি তিনি। ফোনোগ্রাফের মাধ্যমে সবটা রেকর্ড করে রাখতেন। বাড়ি ফিরে বারবার রেকর্ডিং শুনতেন। ঠিক যেমন উচ্চারণে, যেমন ভঙ্গিতে তিনি শুনতেন, কাহিনির বিন্যাসও তেমন ভাবেই করতেন। এ ভাবেই তৈরি হয়ে গেল ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র পাণ্ডুলিপি।
লেখা তো হল। বই ছাপবে কে? তত দিনে দক্ষিণারঞ্জন চলে এসেছেন কলকাতায়। বইপাড়ায় প্রকাশকদের দরজায় ঘুরে লাভ হল না। শেষে পিসিমার টাকায় একটি প্রেস খুললেন তিনি। সব যখন মোটামুটি ঠিকঠাক, তখনই একদিন দক্ষিণারঞ্জনের বাড়িতে হাজির বিখ্যাত অধ্যাপক-গবেষক দীনেশচন্দ্র সেন। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র পাণ্ডুলিপি দেখে তো তিনি চমৎকৃত। জানতে চাইলেন, বই কবে বেরোচ্ছে? দক্ষিণারঞ্জন জানালেন, কোনও প্রকাশক রাজি না হওয়ায় তিনি নিজেই বই প্রকাশ করতে চলেছেন। হতবাক দীনেশচন্দ্র স্বয়ং উদ্যোগী হলেন। তখনকার নামী প্রকাশনা সংস্থা ছিল ‘ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স’। তারাই ছাপে বইটি। ১৯০৭ সালে প্রথম প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে তিন হাজার কপি নিঃশেষিত! এর পরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি দক্ষিণারঞ্জনকে। একে একে এসেছে ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’, ‘ঠানদিদির থলে’, ‘দাদামশায়ের থলে’, ‘চিরদিনের রূপকথা’... বাংলার গীতিকথা, রূপকথা, ব্রতকথার সমুদ্র ছেঁচে তুলে এনেছিলেন তাঁর কাহিনির সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি। শোনা যায়, নিজের বিয়ের রাতেই দক্ষিণারঞ্জন হাতে পান ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র প্রথম কপিটি। সেটিই তুলে দিয়েছিলেন স্ত্রী গিরিবালা দেবীর হাতে।
চুক্তির চেয়ে ঠিক একটা টাকা বেশি নিতেন
তাঁর লেখার হাত ছিল যেমন সরস, মানুষটিও ছিলেন তেমনই। পূর্ণদাস রোডের বাসভবনে বসে সে সব গল্প করছিলেন লেখকের নাতনি সুদীপ্তা ঘোষ। এই বাড়িতেই থাকতেন শিশু সাহিত্যিক। তখন এই রাস্তাটির নাম ছিল মনোহরপুকুর রোড। বাড়ির নাম ছিল ‘সাহিত্যাশ্রম’। সময়ের নিয়মে অবশ্য সেই নামটি ঢাকা পড়ে গিয়েছে।
‘‘আমার মায়ের বিয়ের আগেই দাদু মারা যান। তাই ওঁর স্নেহ পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। দিদিমাও আগে মারা গিয়েছিলেন। বিয়ের আগে দিদিমার পদবি ছিল বসু। বসুশ্রী সিনেমা হল যাঁদের, সেই বাড়ির মেয়ে ছিলেন আমার দিদিমা। আমার মা, মাসির মুখেই অনেক গল্প শুনেছি। খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন উনি। সব সময়ে পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন। চোখে সোনার চশমা, হাতে কাজ করা ছড়ি থাকত। দাদু ছোটদের খুব ভালবাসতেন। এই পাড়ার পুরনোরা বলেন, উনি ছোটদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে গল্প শোনাতেন। বয়াম ভর্তি লজেন্স থাকত, তাদের দিতেন। দাদু নিজেও ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ছিলেন। একটা ঘটনা শুনেছিলাম। বাংলাদেশে হস্টেলে পড়ার সময়ে ভূত সেজে লিচুবাগানে ঢুকে লিচু খেয়েছিলেন!’’
রাজকন্যার আর ঘুম ভাঙ্গে না, রাজপুত্রর চক্ষে আর পলক পড়ে না
সুদীপ্তার মা কল্যাণী ছিলেন ছোট মেয়ে। তিন মেয়ে এক ছেলে ছিল দক্ষিণারঞ্জনের। সব মানুষের মধ্যেই একাধিক পরত থাকে। দক্ষিণারঞ্জনও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। ভিতরে ভিতরে খুব গোঁড়া ছিলেন তিনি। ‘‘আমার মা ভাল গাইতেন। কিন্তু দাদু চাননি মা গানকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করুন। গান রেকর্ডিং করাতে দেননি। খুব কনজ়ারভেটিভ ছিলেন। মেয়েদের রাস্তাঘাটে একা ঘোরাঘুরিতেও নিষেধাজ্ঞা ছিল তাঁর,’’ বলছিলেন সুদীপ্তা।
রসিক মানুষটি জীবনে কম আঘাত পাননি। স্ত্রী মারা যান। সহ্য করতে হয়েছিল পুত্রশোকও। একমাত্র পুত্র রবিরঞ্জনের মৃত্যু হয় অল্প বয়সে। পরপর শোক দক্ষিণারঞ্জনের জীবনবৃক্ষেও আঘাত হানে। খাদ্যপ্রিয় মানুষটি ভুগছিলেন গ্যাসট্রিক আলসারে। ১৯৫৭ সালের ৩০ মার্চ কলকাতায় তাঁর বাসভবনেই দেহ রাখেন দক্ষিণারঞ্জন।
পূর্ণদাস রোডে থাকার আগে লেক মার্কেটের কাছে পরাশর রোডে থাকতেন দক্ষিণারঞ্জন। কিন্তু আর্থিক কারণে সেই বাড়ি বিক্রি করে দেন। কলকাতায় এসে উঠেছিলেন মির্জাপুর স্ট্রিটের (এখন সূর্য সেন স্ট্রিট) মেসে। সেই মেসবাড়িতেই থাকতেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বন্ধুবান্ধব বলতেন, তিন পাগল এক জায়গায় জুটেছে!
প্রকাশক সবিতেন্দ্রনাথ রায় তাঁর বইয়ে লেখকের রসিক মেজাজের পরিচয় দিয়েছেন। রয়্যালটি নিয়ে দরদস্তুর করে একটা রফায় পৌঁছনো হত। তার পরেও চুক্তির থেকে এক টাকা বেশি নিতেন তিনি। বলতেন, ‘এটা শুভ টাকা, হিসেবের বাইরে।’ প্রকাশকেরা বলতেন, ‘আর আসলটা কি অশুভ?’ লেখকের সরস জবাব, ‘তা কেন, দেখ না পুজো দেয় ৫১ টাকা বা ১০১ টাকা, এ-ও সেই রকম। এ-ও তো পুজো, সরস্বতীর পুজো।’
দক্ষিণারঞ্জন খেতে এবং খাওয়াতে ভালবাসতেন। সবিতেন্দ্রনাথের বই ‘নিজস্বী’তে লেখকের খাদ্যপ্রেমের পরিচয় রয়েছে। দক্ষিণারঞ্জন বলছেন, ‘আরে তোমার বয়সে আমি এমন চার থালা খেতে পারতাম।’ তাঁর নাতনি সুদীপ্তার কথায়, ‘‘দাদু দুধ, মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন। বাড়িতে কেউ এলে তাঁকে না খাইয়ে ছাড়তেন না।’’
বইয়ের পাতায় পাতায় রূপকথার উৎসব
যে সময়টায় দক্ষিণারঞ্জনের উত্থান, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ নিয়ে তাঁর স্ট্রাগলের সময়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলছে। লেখক নিজেও ছিলেন স্বদেশিয়ানায় ভরপুর। শুধু ছোটদের লেখাতেই নিজেকে আটকে রাখেননি। তাঁর স্বদেশ-প্রেমমূলক গানের সঙ্কলন ‘মা বা আহুতি’ সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি উচ্চ পর্যায়ে আসীন। সেই সাম্রাজ্যের চুড়োয় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তা সত্ত্বেও নিজের স্বতন্ত্র পরিচয়ের স্বাক্ষর রেখেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন।
ছোটদের লেখায় বাস্তব ঘটনাকে স্থান দেননি তিনি। নির্দিষ্ট কোনও দেশ বা স্থানের উল্লেখও করতেন না। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র সব গল্প শুরু হয়েছে ‘এক’ দিয়ে। এক রাজা, এক দেশ, এক রাজপুত্র... যাতে শিশুর কল্পনা ডালপালা মেলতে পারে। তাঁর বই শুধু পড়ার নয়, দেখারও। গল্পের সঙ্গে তাঁর আঁকা ছবিগুলি এখনও বইয়ে ব্যবহৃত হয়। ‘ছোটরাণী আছাড় খাইয়া মাটিতে পড়িলেন’, ‘শুকপঙ্খী নৌকা অনেক দূরে চলিয়া গেল’, ‘হাড়মুড়্মুড়ী ব্যারাম’, ‘সুক-সারি’, ‘সোনার কাঠি রুপোর কাঠি’— পাতায় পাতায় রূপকথার উৎসব। আর সবই সাদা-কালোয়। তাঁর আঁকা নিয়ে সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন, ‘‘একরঙা ছবিতে ছোটরা কল্পনা করে, কোনটা কী রং হবে। এতে তাদের কল্পনাশক্তির বিকাশ হয়... এই জন্য টুনটুনির বইয়ের সব ছবি একরঙা। তবে আদর্শ ওই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। লেখক শুধুমাত্র টাইপ ছোট বড় করে লেখা গল্পতে, বলার ভঙ্গি এনে দিয়েছেন। আর কী সুন্দর সব উডকাট ছবি। প্রতিটি ছবি গল্পের সঙ্গে মানানসই।’’
দক্ষিণারঞ্জন হাতে আঁকতেন। সেই আঁকা থেকে শিল্পীরা কাঠ কেটে রূপ দিতেন। সবিতেন্দ্রনাথ তাঁর বইয়ে লেখকের সঙ্গে নিজের কথোপকথন উদ্ধৃত করেছেন। বাড়িতে রাখা ছবি দেখিয়ে লেখক বলছেন, ‘‘ভানু দ্যাখো, এই সব উডকাট ছবি আমার করা। ভাবো চাইনিজ় নিব দিয়ে চাইনিজ় কালো কালিতে কত কষ্ট করে করা। তারপর গরানহাটায় গিয়ে উডকাট-এর ব্লক করানো...’’
পূর্ণদাস রোডের বাড়ির দেওয়ালে চুনের রঙে ফাটল ধরেছিল। সেই ফাটল দিয়ে দেওয়াল জুড়ে নকশা তৈরি করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। ‘‘দেওয়ালে যে চুনের ফাট, মাঝে মাঝে সেগুলো কালি দিয়ে জুড়ে জুড়ে কী অসামান্য দেওয়াল-চিত্র রচনা করেছেন,’’ লিখেছেন সবিতেন্দ্রনাথ রায়। সেই দেওয়াল শিল্পের ছবি কেউ তুলে রাখেনি। পরে বাড়িটি চুনকাম করা হলে সেই সৃষ্টি হারিয়ে যায়।
যতিচিহ্নের ব্যবহারেও দক্ষিণারঞ্জনের অবদান রয়েছে। মা-ঠাকুমারা গল্প বলার সময়ে যে ভঙ্গিতে বলতেন, ঠিক সেটাই লেখায় ফুটিয়ে তুলতেন।
আমার কথাটি ফুরা’ল
নটে গাছটি মুড়া’ল
গল্প বলার সময়ে মা-ঠাকুমাদের গলার স্বরটুকুই শুধু ছোটদের কানে যায় না। সেই সঙ্গে থাকে হাতের স্পর্শের আরাম। এখন আর সে সবের অবকাশ নেই। পরিবারের ছোট্ট গণ্ডিতে শিশু ভোলানোর হাতিয়ার মোবাইল কিংবা টেলিভিশন। বইয়ের পাতার অক্ষর শিশুমনের নাগাল পায় না। যারা পড়ে, তাদের বইয়ের মলাটে জ্বলজ্বল করে ইংরেজি অক্ষর।
বাংলা রূপকথার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলে থাকেন। কল্পনার শাখায় ভর করে মানুষের মন তো যত দূর চায় পাড়ি দিতে পারে। সেই অসম্ভবের ছাড়পত্র আছে রূপকথার। তাই সেখানে মন্ত্রপূত জল, মানুষের গর্ভে বানররূপী পুত্র, বুড়ো আঙুল মাপের শিশু, ছোট্ট কৌটোয় রাক্ষসের প্রাণভোমরা— বেমানান নয়। শুধু বাংলা কেন, সারা বিশ্বের রূপকথা খুঁজলেও এমন উদাহরণ মিলবে। এতে কাহিনির চরিত্রহানি হয় না।
যথাযথ কৃতিত্ব পান বা না-ই পান, দক্ষিণারঞ্জনের সৃষ্টি আজও অমলিন। টেলিভিশনের পর্দায় তাঁর কাহিনির আধারে শো তৈরি হয়। লেখকের নাতনি সুদীপ্তা ঘোষ বলছিলেন, ‘‘২০১৭ সালে কপিরাইট উঠে গিয়েছে। ফলে এখন যে যার মতো ওঁর লেখার সাহায্য নিচ্ছে। তবে কপিরাইট থাকাকালীনও টিভির অনুষ্ঠান বা সিনেমার জন্য কোনও টাকা ওঁর পরিবার পায়নি। অবশ্য নীতীশ রায় (‘বুদ্ধু ভূতুম’ ছবির পরিচালক) ব্যতিক্রম। ছোট পর্দার কিছু অনুষ্ঠানে তো ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র গল্পগুলোকে রীতিমতো বিকৃত করা হয়েছে। কেউ দাদুর নামও দেয়নি, টাকাও নয়। তবে এত বিকৃত করেছে যে, নাম না দিয়ে এক রকম ভালই হয়েছে।’’
আমাদের দেশে শিশু সাহিত্যিকদের যথাযথ মর্যাদা নেই। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়ের কথা মাথায় রেখেও তা বলা যায়। হান্স অ্যান্ডারসন, লুই ক্যারল, গ্রীমভাইদের রচনা সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের রূপকথার চরিত্ররা সিনেমার পর্দায় এসেছে, থিম পার্ক হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, বিপণন হয়েছে। এ দেশে এত কিছু আশা করাই বৃথা। কিন্তু তা সত্ত্বেও সোঁদা মাটির গন্ধমাখা দক্ষিণারঞ্জনের রূপকথা শিশুমনের পক্ষীরাজে আজও সওয়ার হয়।
ঋণ: সুদীপ্তা ঘোষ,
‘নিজস্বী’: সবিতেন্দ্রনাথ রায়