সন্ধ্যের মুড়িমাখা, সঙ্গে সিঙ্গাড়া
তখন দুপর। লাঞ্চ ব্রেকের পরে অফিসে জোড় কদমে কাজ চলছে। কাঁচের জানলা দিয়ে একফালি আকাশ নজরে আসতে মনটা কেমন কেমন করে উঠলো সায়নের। মেঘ জমেছে ভীষণ, যেন অনেক কালের অভিমান!
সেমন্তীর আজ ছুটি। কয়েক দিন আগে খুব জ্বরে ভুগেছে সে। এখন জ্বর নেই। কোনও এক কারণে মনে জমে রয়েছে একরাশ বিষাদ। বিস্বাদও আছে! জ্বরে অনেক সময় স্বাদ থাকে না, আগেকার দিনের পিসি, ঠাকুমারা এই সময় একটু তেতো খেতে বলতেন স্বাদ ফেরাতে। দারুণ টোটকা! কিন্তু বিষাদের কোনও সহজ টোটকা আছে কি? উত্তর খুঁজতে থাকে সেমন্তী। কফি নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে। আকাশের সঙ্গে মনের যেন গভীর যোগ তার। দু’জনেরই মুখ ভার।
কফিতে চুমুক দিতে দিতে তার মনে পড়ে যায় বছর কুড়ি আগের বৃষ্টিবেলার কথা। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় বৃষ্টির জলে পা ভেজানো, নৌকা ভাসানোর কথা। কত বকা খেতে হয়েছে সেই সময় স্কুলের ইউনিফর্মে কাদা মাখানোর জন্যে। শুধু কী তাই! এই তো বছর খানেক আগের কথা। তখনও সাউথ-সিটিতে ফ্ল্যাট কেনা হয়নি। রিষড়ায় দাদুর বাড়িতে আষাঢ়ের এই সময়টা বৃষ্টি হলেই ভাই-বোনেরা মিলে সব ছুটে বেড়াতো উঠোনে। সন্ধে বেলা বাবা কাকারা অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে ঝালমুড়ি আর গরম গরম সিঙ্গাড়া নিয়ে বসত সকলে। কাকিমা অসাধারণ চা বানাতো। এলাচ, আদা, আরও কীসব থাকত চায়ে। আর রাত্তিরের মেনু হতো গরম গরম গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, বেগুন ভাজা আর অমলেট। উফ এখনও যেন গন্ধ আসছে ভেসে!
কফি শেষ করে ঘরে এল সেমন্তী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত কিছু বদলে যায়। সায়নের সঙ্গে তার পাঁচ বছরের সম্পর্ক। নিজের পছন্দ করে বিয়ে করা, চাকরি, সংসার সব কিছু সে চ্যালেঞ্জ করে নিজের হাতে গড়ে তুলেছে। সায়ন খুব ভাল। যথেষ্ট যত্ন নেয় সে তার। কিন্তু এই জ্বরের সময়টাতে সেমন্তীর মায়ের কথা মনে পড়ে খুব। রাত জেগে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, জলপট্টি দেওয়া, দুপুরে জোড় করে নিম-বেগুন খাইয়ে দেওয়া – এই সব খুব মিস করে সে। বিশেষ করে বৃষ্টি ভেজা সন্ধেতে পরিবারের সকলে মিলে ঝালমুড়ি খাওয়া, খিচুড়ি খাওয়ার গল্পগুলো।
সন্ধে ছ'টা। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আজকাল বৃষ্টি হলে এত মেঘ ডাকে, বুক ঢিপ ঢিপ করে ওঠে। সায়ন'কে ফোনে যোগাযোগ করা গেল না বলে চিন্তাটা বাড়ল সেমন্তীর। বৃষ্টি কমলে যেন সে অফিস থেকে বের হয়– এইটুকুই বলার ছিল তাকে। এই সবে জ্বর থেকে উঠেছে নিজে। দু’জন মিলে অসুস্থ হলে কে কাকে দেখবে, সেই অবস্থা হবে।
প্রায় সাড়ে সাত’টা বেজে গেল। এবার সত্যিই চিন্তা বাড়ল সেমন্তীর। বৃষ্টি কমেছে অনেকক্ষণ হল। এখনও বাড়ি ফিরল না কেন সায়ন! বলে ছিল সারপ্রাইজ দেবে। তা সে কখন! কোনও বিপদ হল না তো রাস্তায়। যা দিনকাল পড়েছে!
হঠাৎ কলিং বেল!
— “দেরি হচ্ছে একটা ফোন করতে পারো না” – গজগজ করতে করতে দরজা খুলল সেমন্তী।
— “মা – বাবি – কাকাই– ছুটকি তোমরা! তোমরা এসেছ!” – গলা ভিজে এল সেমন্তীর। চোখের জল সামলাতে পারল না সে আর।
— “জামাই এত করে বলল! তা ছাড়া তোর জ্বর শুনলাম। আর না এসে পারি বল। কেমন আছিস সমু– ” বুকে জড়িয়ে ধরলো মেয়েকে মা।
“একটু খিচুড়ি করে দেবে মা? দেখ কেমন বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে“ — অমনি বায়না শুরু।
ছুটকি ছুটে এসে বলল — “ঝালমুড়ি হবে নাকি একটু এখন সিঙ্গাড়া দিয়ে?“
আর সায়ন! সে তো বন্ধু ছিলই বর হয়ে ওঠার আগে। তবে আজ থেকে সেমন্তীর প্রিয় বন্ধু সে। বৃষ্টির দিনের ঝালমুড়ির সঙ্গে সিঙ্গাড়ার মতোই।
এই প্রতিবেদনটি সংগৃহীত এবং 'আষাঢ়ের গল্প' ফিচারের অংশ।