হৃদয় কী চায়, মেরামতি না প্রতিস্থাপন

বছর তিরিশের মেয়েটির সন্তান ধারণে এমনিতে অসুবিধা নেই। তবু তাঁর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পথে একটা বড় বাধা রয়েছে। সেটা কী? বছর পাঁচেক আগে তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ভালভ্ প্রতিস্থাপন হয়েছে। তাই নিয়মিত তাঁকে রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ খেতে হয়। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, ফলে প্রসবের সময়ে যে রক্তক্ষরণ হয়, সেটাই তাঁর পক্ষে বড় ঝুঁকি এমন কী জীবনহানির কারণও হতে পারে। ওই ওষুধ ক্ষতি করতে পারে তাঁর ভাবী সন্তানেরও।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৪ ০২:৩৯
Share:

বছর তিরিশের মেয়েটির সন্তান ধারণে এমনিতে অসুবিধা নেই। তবু তাঁর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পথে একটা বড় বাধা রয়েছে। সেটা কী? বছর পাঁচেক আগে তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ভালভ্ প্রতিস্থাপন হয়েছে। তাই নিয়মিত তাঁকে রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ খেতে হয়। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, ফলে প্রসবের সময়ে যে রক্তক্ষরণ হয়, সেটাই তাঁর পক্ষে বড় ঝুঁকি এমন কী জীবনহানির কারণও হতে পারে। ওই ওষুধ ক্ষতি করতে পারে তাঁর ভাবী সন্তানেরও।

Advertisement

হৃদ্যন্ত্রের ভালভ্ প্রতিস্থাপনের কারণে টানা কয়েক বছর রক্ত পাতলা হওয়ার ওষুধ খেতেন বছর চল্লিশের এক স্কুল শিক্ষক। এক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দিন কয়েক কলকাতার এক হাসপাতালে ভর্তি থাকার পরে মৃত্যু হয় তাঁর। চিকিৎসকরা জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণই তাঁর মৃত্যুর কারণ।

হৃদ্যন্ত্রের বিকল ভালভের চিকিৎসা ঘিরে এমন উদাহরণ বহু। রয়েছে নানা প্রশ্ন-বিতর্কও। হৃদ্রোগীকে নতুন জীবন দিতে কোন পদ্ধতিটি বেশি উপযোগী? নকল ভালভ্ প্রতিস্থাপন? নাকি পুরনো ভালভের মেরামতি? চিকিৎসার খরচ থেকে শুরু করে আয়ুকার পাল্লা ভারী?

Advertisement

এই প্রশ্নটা গত কয়েক বছর ধরেই অকেজো ভালভের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ঘোরাফেরা করছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে ইতিমধ্যেই ভালভ্ মেরামতির পক্ষেই রায় দিয়েছেন চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। কিন্তু এ দেশে, বিশেষত পূর্বাঞ্চলে ভালভ্ মেরামতি চালু হলেও তেমন জনপ্রিয় হয়নি।

কেন? এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের একটা অংশের যুক্তি, ভালভ্ মেরামতির জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন, বহু ক্ষেত্রেই তা থাকে না। পাশাপাশি এর ঝুঁকিও প্রচুর। প্রতিস্থাপনের তুলনায় মেরামতির খরচ বেশ খানিকটা কম। ফলে চিকিৎসকরা তো বটেই, হাসপাতালগুলিও এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় কম। যে হেতু রোগীদের মধ্যে এ বিষয়ে এখনও সচেতনতা তৈরি হয়নি, তাই তাঁরাও নিজে থেকে চিকিৎসককে এ কথা বলেন না। এই পরিস্থিতিতে রোগীদের সচেতনতা বাড়ানো এবং প্রতিস্থাপনের পরিবর্তে ভালভ্ মেরামতির বিষয়ে তাঁদের ধারণা স্পষ্ট করার উপরে গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, সচেতন না হলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সুবিধা থেকে রোগীরা বঞ্চিতই থেকে যাবেন।

হৃদ্যন্ত্রের বাঁ দিকের অলিন্দ আর নিলয়ের মাঝখানে থাকে মাইট্রাল ভালভ্। নানা কারণে এই ভালভ্ অকেজো হয়ে যেতে পারে। কখনও ভালভ্ সরু হয়ে যাওয়ায় রক্ত চলাচলে সমস্যা হয়, আবার কখনও বা তা ফুটো হয়ে রক্ত প্রবাহের স্বাভাবিক গতিকে নষ্ট করে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বহু দিন পর্যন্ত এই সমস্যার একটাই সমাধান ছিল, তা হল ভালভ্ প্রতিস্থাপন। আসল সরিয়ে ধাতব ভালভ বসানো। কিন্তু তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তো আছেই, সঙ্গে আজীবন নানা নিয়মও মেনে চলতে হয়। শিশুদের ভালভ্ প্রতিস্থাপনের সমস্যা রয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, শিশুদের মাইট্রাল ভালভ্ খারাপ হলে ছোট ধাতব ভালভ্ বসানো হয়। শিশুটি বড় হলেও ভালভের আকার তো বাড়ে না। ফলে তা নানা সমস্যা তৈরি করে। ফের প্রয়োজন পড়ে অস্ত্রোপচারের।

দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতালের চেয়ারম্যান, কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সত্যজিৎ বসু বলেন, “শুধু খরচ বা জটিলতা এড়ানো নয়, আয়ু বাড়ানোর স্বার্থেও ভালভ্ মেরামতি খুব জরুরি। যাঁদের দেহে ধাতব ভালভ্ বসানো হয়, তাঁদের মধ্যে ৫০ শতাংশ মানুষই ১০ বছরের বেশি বাঁচেন না। কারণ প্রতিস্থাপনের নানা জটিলতা থাকে। কম বয়সিদের ধাতব ভালভ্ বসালে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও নানা বিধিনিষেধ তৈরি হয়।” সেটা কেমন? তিনি জানান, রক্ত পাতলা হওয়ার ওষুধ বরাবর খেয়ে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে মাত্রাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কম খেলে সমস্যা, আবার বেশি খেলেও থ্রম্বোসিস হয়ে মৃত্যু হতে পারে।

দুর্গাপুরের ওই হাসপাতালে আজ, বৃহস্পতিবার থেকে মাইট্রাল ভালভ্ মেরামতির উপরে দু’দিনের একটি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। হাজির থাকবেন সব মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওথোরাসিক সার্জনরা। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে কী ভাবে ভালভ্ মেরামতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটাই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওথোরাসিক বিভাগের প্রধান চিকিৎসক ভবতোষ বিশ্বাস বলেন, “ভালভ্ মেরামতির জন্য দক্ষতার প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই হয়তো অনেকে ঝুঁকি নেন না। তা ছাড়া একবার মেরামতির বছর কয়েক পরে ফের মেরামতি প্রয়োজন হতে পারে। তাই অনেকেই সেই পথে হাঁটতে চান না। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি, প্রতিস্থাপন নয়, মেরামতিটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ এতে জীবনযাত্রার মান অনেকটাই স্বাভাবিক থাকে।” কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওথোরাসিক সার্জন প্লাবন মুখোপাধ্যায়ও বললেন, “কমবয়সিদের ক্ষেত্রে ভালভ্ প্রতিস্থাপন নানা বিপদ ডাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে মেরামতিই সেরা পন্থা।”

কিন্তু অন্য মতও রয়েছে। কার্ডিওথোরাসিক সার্জনদের একটা অংশ মনে করেন, এ দেশে রোগের ধরনটাই এমন যে ভালভ্ মেরামতির সুযোগ কম। বিষয়টির ব্যাখ্যা করে তাঁরা জানান, ইস্কিমিক হার্টের ক্ষেত্রে ভালভ্ খারাপ হলে প্রতিস্থাপন করা যায়। কিন্তু এ দেশে ‘রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ’-এর জেরেই ভালভ্ নষ্ট হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। এতে ভালভ্ শুকিয়ে, গুটিয়ে ছোট হয়ে যায়। বহু ক্ষেত্রে ভাল্ভে ক্যালসিয়াম জমে শক্ত হয়। মেরামতিও অসম্ভব হয়ে পড়ে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement