কাগজে-কলমে যা দাবি করা হচ্ছে, বাস্তবের সঙ্গে তা মিলছে না। দুইয়ের মধ্যে বহু যোজনের ফারাক। যা কি না ধরা পড়েছে খোদ দাবিকর্তাদেরই পাঠানো প্রতিনিধিদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণে!
প্রসঙ্গ সেই এনসেফ্যালাইটিস। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দফতর বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে, রোগ-পরিস্থিতি সম্পর্কে যথাসময়ে স্বাস্থ্যভবনে রিপোর্ট প্রেরণের ক্ষেত্রে গাফিলতি থাকলেও চিকিৎসায় কোনও ত্রুটি হয়নি। অথচ দফতরের ডাক্তারেরাই উত্তরবঙ্গের জেলায়-জেলায় ঘুরে চিকিৎসা পরিকাঠামোর যে ছবিটা দফতরের সামনে তুলে ধরেছেন, তা হলফনামার বক্তব্যকে সমর্থন করছে না। ওঁদের অভিজ্ঞতা বলছে, গোড়ার দিকে কার্যত রোগ নির্ণয় ছাড়াই চিকিৎসা হয়েছে রোগীদের। কেন?
জেলা ঘুরে আসা চিকিৎসকদের মতে, এর মূল কারণ হেলদোলের অভাব। কোথাও রোগ মাথা চাড়া দেওয়ার পরেও হাসপাতালের ল্যাবরেটরি বন্ধ থেকেছে। কোথাও আবার অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোমের (এইএস) রোগীর ঢল দেখে হাসপাতালের কর্তারা আবিষ্কার করেছেন, কিটের মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে! কোথাও বা জেলার মেডিক্যাল কলেজের হাল মহকুমা হাসপাতালের চেয়েও খারাপ! সুপার থেকে ডাক্তার, কেউই সেখানে সপ্তাহে দু’দিনের বেশি থাকেন না! স্বাস্থ্যভবনের প্রতিনিধিদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিস-পরিস্থিতি গুরুতর আকার নেয় ৭ জুলাই নাগাদ। কিন্তু ১৬ জুলাই পর্যন্ত জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের কোনও পরীক্ষা করা যায়নি, কারণ কোথাও একটাও কিট ছিল না। রিকুইজিশনে দেরি হওয়ায় পুণে থেকে কিট আসতেও দেরি হয়েছে।
দফতরের খবর: রক্তে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু নির্ণয়ের ‘কিট’ মার্কিন মুলুকে তৈরি হয়। পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি তা কিনে অনুমোদিত ল্যাবগুলিতে সরবরাহ করে। পশ্চিমবঙ্গে এমন সাতটি ল্যাব রয়েছে কলকাতার ট্রপিক্যাল, এসএসকেএম এবং নাইসেডে, বাঁকুড়া মেডিক্যাল, বর্ধমান মেডিক্যাল, মালদহ মেডিক্যাল ও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে। বাজারে খুব অল্প যা বিক্রি হয়, বিভিন্ন রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরই বাড়তি প্রয়োজনে তা কিনে নেয়। কিটের জন্য বহু আগে রিকুইজিশনও দিতে হয়। এবং অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল এত সব ঝামেলায় জড়াতে চায় না বলে তাদের জাপানি এনসেফ্যালাইটিস পরীক্ষারও ব্যবস্থা নেই।
এমতাবস্থায় এনসেফ্যালাইটিস মোকাবিলার দায়টা মূলত সরকারি হাসপাতালের। ঘটনা হল, গত ক’বছর যাবৎ এই সময়টায় উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ-সহ খিঁচুনি জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখেও কর্তৃপক্ষ আগাম সতর্ক হননি। খেয়ালই করেননি, যে কিট ফুরিয়ে গিয়েছে! স্বাস্থ্যভবন শেষে বাজার থেকে ছ’টা কিট কোনও মতে জোগাড় করে। যার অধিকাংশ খরচ হয়ে যায় ট্রপিক্যালে আর নাইসেডে। জেলার ভাগ্যে জুটেছে যৎকিঞ্চিৎ।
ত্রুটির তালিকা এখানেই শেষ নয়। দফতরের নিজস্ব পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, সঙ্কটের সময়েও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের ল্যাব দিনে দু’-তিন ঘণ্টার বেশি চালু থাকত না (২৪ ঘণ্টা চালু রাখার কথা)। ফলে কিট হাতে পেয়ে পরীক্ষা শুরু হলেও রিপোর্ট পেতে বিস্তর সময় গড়িয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে মালদহে এইএস-রোগীর চাপ বাড়ার পরে মেডিক্যাল-কর্তৃপক্ষের নজরে আসে যে, তাঁদের স্টোরের কিটটির মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে গত এপ্রিলে!
এমন হল কেন, সে প্রসঙ্গে উত্তরবঙ্গ বা মালদহ মেডিক্যালের কর্তৃপক্ষ মন্তব্য করতে চাননি। উল্লেখ্য, কর্তব্যে গাফিলতি ও তথ্য গোপনের দায়ে উত্তরবঙ্গের চার স্বাস্থ্য-আধিকারিককে নবান্ন সাসপেন্ড করেছে, বদলি করা হয়েছে বেশ ক’জনকে। “স্বাস্থ্যভবনে খবর পৌঁছানোর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমরা যা পদক্ষেপ করার করেছি। ল্যাবরেটরি চব্বিশ ঘণ্টা খোলা রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। আরও নার্স দেওয়া হয়েছে।’’ দাবি করছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, “এগুলো ওখানকার কর্তৃপক্ষই করতে পারতেন। করেননি। এটা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা যায় না।” কিন্তু গাফিলতির দায়ে উত্তরবঙ্গের অধ্যক্ষ সাসপেন্ড হলেও মালদহকে রেহাই কেন জানতে চাওয়া হলে স্বাস্থ্যভবনের শীর্ষ মহল ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তাই শাস্তির ব্যবস্থা রয়ে-সয়ে করা ছাড়া উপায় নেই।
উত্তরের মতো দক্ষিণও তথৈবচ। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “মেদিনীপুর মেডিক্যালে ভয়াবহ অবস্থা। প্রতিনিধিরা গিয়ে দেখেছেন, অধিকাংশ জায়গায় ডাক্তারেরা থাকেন না। অনেকে কলকাতায় চেম্বার সামলাতে চলে আসেন। ল্যাব চলে নাম-কা-ওয়াস্তে। চারদিক নোংরা, যখন-তখন সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা।” প্রসঙ্গত, মেদিনীপুরেও এইএসের রোগী মিলেছে।
তা হলে ভরসা তো সেই কলকাতা! এখানে কী হাল?
গত কয়েক দিনে কলকাতার হাসপাতালেও জাপানি এনসেফ্যালাইটিস এবং খিঁচুনি-জ্বরে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যদিও সকলেই বাইরে থেকে রোগ নিয়ে এসেছিলেন। তবে স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশ একান্তে কবুল করেছেন, খাস মহানগরের মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও এনসেফ্যালাইটিস মোকাবিলায় ন্যূনতম পরিকাঠামো তৈরি নেই। “সকলে এই ভেবে নিশ্চিন্ত যে, কলকাতায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিস হয় না। হলে কী করা যাবে, অন্য জায়গা থেকে আসা রোগীর চিকিৎসায় কী কী দরকার, তা নিয়ে কারও বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই!” আক্ষেপ এক কর্তার। ওঁদের অনেকের মতে, স্রেফ ক’জনকে সাসপেন্ড করে কাজের কাজ কিছু হবে না। পুরো ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টানো দরকার। উঁচু থেকে নিচু, সকলের মধ্যে সচেতনতা আনাও সমান জরুরি।
এই ব্যর্থতার দায় স্বাস্থ্যভবনের মাথাদের উপরেও বর্তায় না কি?
শুনে সুশান্তবাবুর প্রতিক্রিয়া, “অবান্তর প্রশ্ন। মেডিক্যাল কলেজ কী ভাবে চলছে, তা দেখার দায়িত্ব অধ্যক্ষের। জেলার স্বাস্থ্য পরিকাঠামো দেখার জন্য মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রয়েছেন। সব কিছু স্বাস্থ্যভবন থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়।”