পরিকাঠামো রয়েছে। কিন্তু তার সদ্ব্যবহার করতে ডাক্তারেরা কতটা তৎপর? এম আর বাঙুর হাসপাতালে এক নবজাতকের মৃত্যু গোটা রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামনে সেই প্রশ্ন তুলে দিল। বাঙুর হাসপাতালে ‘সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিইউ) থাকা সত্ত্বেও ওই হাসপাতালে জন্মানো একটি শিশু কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তার পরিবারের লোকেরা। বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যেই এ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায়।
যে শিশুর মৃত্যুকে ঘিরে এই প্রশ্ন, জন্মের সময়ে তার ওজন ছিল ৩ কেজি ৮০০ গ্রাম। তার কোনও রকম শারীরিক সমস্যার কথা চিকিৎসকেরা শিশুটির পরিবারকে জানাননি। হাসপাতালের কাগজেও তেমন কিছু লেখা হয়নি। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কী করে এই শিশুটি মারা যেতে পারে, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে স্বাস্থ্যকর্তাদের দ্বারস্থ হয়েছেন পরিবারের লোকেরা।
বাঙুরের চিকিৎসক মহলের একটি বড় অংশের বক্তব্য, মা ও নবজাতকের মৃত্যু-হার কমাতে রাজ্য জুড়ে ‘সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট’ খুলেছে স্বাস্থ্য দফতর। তাতে শিশু-মৃত্যুর হার কিছুটা হলেও কমেছে। কিন্তু ঠিক সময়ে শিশুদের ওই ইউনিটে পাঠানোর ক্ষেত্রে কতটা তৎপরতা দেখাচ্ছেন ডাক্তারেরা, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে।
প্রতিমা দাস নামে ৩৫ বছরের এক মহিলার সন্তান জন্মায় গত ১২ ডিসেম্বর। বিয়ের ১৩ বছর পরেও সন্তান হচ্ছিল না প্রতিমাদেবীর। এক স্ত্রীরোগ চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা করিয়ে অন্তঃসত্ত্বা হন তিনি। বেসরকারি হাসপাতালে প্রসবের সামর্থ্য না থাকায় সরকারি হাসপাতালেরই দ্বারস্থ হন। নভেম্বরের শেষ থেকেই তাঁর শারীরিক কিছু সমস্যা হওয়ায় একাধিক বার বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি হতে যান প্রতিমাদেবী। অভিযোগ, প্রতিবারই সেখান থেকে ফিরিয়ে দিয়ে তাঁকে বলা হয়, প্রসবে দেরি আছে। বহু অনুরোধের পরে ১২ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান তিনি। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেই রাতেই সিজারিয়ান সন্তান জন্মায় তাঁর। জন্মের সময়ে শিশুটি সব দিক থেকেই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেই স্বাস্থ্যবান, স্বাভাবিক শিশুটিই দু’দিন পরে অর্থাৎ, ১৫ তারিখ মারা যায়। কী করে একটি আপাত সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুর এমন পরিণতি হতে পারে, সেই প্রশ্ন তুলে স্বাস্থ্য কর্তাদের দ্বারস্থ হন শিশুটির পরিবারের লোকেরা।
বাঙুরের এই ঘটনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক তদন্তে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জেনেছেন, ১৩ তারিখ বিকেলের পর থেকেই শিশুটির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করে। মায়ের দুধ খেতে পারছিল না শিশুটি। একই সঙ্গে তার শ্বাসকষ্টও শুরু হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও তাকে ওয়ার্ড থেকে এসএনসিইউ-তে নিয়ে যাওয়া হয়নি। তার বাড়ির লোকেরা ওয়ার্ডের চিকিৎসককে শারীরিক সমস্যার কথা জানান। সেই অনুযায়ী প্রসূতি ওয়ার্ড থেকে পেডিয়াট্রিক বিভাগের চিকিৎসকের কাছে নোট পাঠানো হয়। আশ্চর্যজনক ভাবে সেই নোটে লেখা ছিল, ‘শিশুর বাড়ির লোকের অভিযোগ অনুযায়ী তার খেতে সমস্যা হচ্ছে এবং শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।’ ‘শিশুর বাড়ির লোকের অভিযোগ অনুযায়ী’ কথাটি লেখা হয়েছে কেন, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে। এর অর্থ কি ওয়ার্ডের চিকিৎসক শিশুটিকে পরীক্ষা করেননি? ওয়ার্ডের চিকিৎসকেরা গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করলেও প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি। সংশ্লিষ্ট স্ত্রীরোগ চিকিৎসক ও শিশু চিকিৎসক কর্তৃপক্ষকে জানান, শিশুটির জন্মগত কিছু সমস্যা ছিল। তার জেরেই মৃত্যু।
জন্মগত সমস্যা থাকলে তখনই পরিজনেদের জানানো হয়নি কেন, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে। এর উত্তর তাঁরা দিতে পারেননি। বাঙুরের এসএনসিইউ-তে ১৪ তারিখ সন্ধ্যায় শিশুটিকে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তার অবস্থা খুবই খারাপ। কেন সময়মতো শিশুটিকে ওয়ার্ড থেকে এসএনসিইউ-তে নিয়ে যাওয়া হল না, তার কোনও ব্যাখ্যাও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা চিকিৎসকদের কাছে পাওয়া যায়নি।
সন্তানধারণের জন্য যে স্ত্রীরোগ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন প্রতিমা, সেই সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় বলেন, “বেশি বয়সে প্রথম বার গর্ভধারণ করলে অনেক ঝুঁকি থাকে। হাসপাতালের উচিত ছিল পরিকল্পিত ভাবে আগে থেকে ভর্তি নিয়ে সিজারিয়ান প্রসবের ব্যবস্থা করা এবং শিশুটির উপরে সব সময়ে নজর রাখা। এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। দুর্ভাগ্যজনক।”