সন্তান প্রসবের পরে চার মাস কেটে গিয়েছে আদুরি বিবির। পশ্চিম মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা, ২২ বছরের আদুরির সন্তান জন্মেছে জেলা হাসপাতালে। বাড়ি থেকে হাসপাতালে পৌঁছনোর জন্য নিখরচায় গাড়ি পাওয়া যায়, সে কথা শুনেছিলেন তিনি। কিন্তু নিজে সেই সুবিধা পাননি। প্রসবের পরে ৫০০ টাকা পাওয়া যায় শুনেছিলেন। সন্তান জন্মের পরে চার মাস জুতোর সুকতলা খইয়ে ফেলেও সে টাকা আদায় করতে পারেননি। বিরক্ত, হতাশ আদুরি এখন তাঁর প্রতিবেশীদের কাছে আক্ষেপ করেন, “কী লাভ হল হাসপাতালে গিয়ে? এর চেয়ে তো বাড়িতে দাইয়ের কাছে বাচ্চা হলে এত খরচের হাত থেকে বাঁচতাম।” পরের বার অন্তঃসত্ত্বা হলে আর যে হাসপাতালে ছুটবেন না, সে কথাও তিনি আগেভাগে জানিয়ে দিয়েছেন।
এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জননী সুরক্ষা যোজনার শর্ত মেনে প্রতিষ্ঠানে প্রসব হওয়ার পরেও বিভিন্ন জেলায় বহু মহিলা নির্দিষ্ট সময়ে ভাতা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের পিছনে তা হলে কি স্রেফ আর্থিক প্রলোভনটাই বড় হয়ে থাকবে? স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অংশুমান চৌধুরীর বক্তব্য, “যে কোনও নতুন প্রকল্প সফল করতে গেলে তার ইতিবাচক দিকটা মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া দরকার। আর সে জন্য গোড়ায় কিছু প্রলোভনের প্রয়োজন পড়তেই পারে। প্রত্যন্ত গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারই প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের গুরুত্ব বোঝেন না। কেন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরে এক জন মহিলার নির্দিষ্ট দেখভাল, ওষুধপত্র প্রয়োজন হয়। কেন শিশুর টিকাকরণ জরুরি, সে সম্পর্কে অনেকেরই কোনও সম্যক ধারণা নেই।” কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, “রাতারাতি কোনও তত্ত্ব মাথায় জোর করে ঢোকাতে গেলে মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তাই প্রথমে তাঁদের ওই ব্যবস্থার শরিক করে তুলতে হবে। পরে তাঁরা নিজেরাই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন।”
জননী সুরক্ষা যোজনা সেই গুরুত্ব উপলব্ধি করাতে ব্যর্থ হয়েছে, সে কথা বলা যায় না। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তারা নিজেরাই মানছেন, এই প্রকল্প যতটা সফল হওয়া সম্ভব ছিল তা হয়ে উঠতে পারেনি। বহু প্রসূতি এখনও সময় মতো তাঁদের প্রাপ্য টাকা পাচ্ছেন না। নিখরচায় মা ও শিশুর সমস্ত ওষুধপত্র ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও জেলায় তো বটেই এমন কী খাস কলকাতা শহরেও বহু জায়গায় তা মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারি নথিতেও তার প্রমাণ রয়েছে।
২০০৫ সালে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে চালু হয় জননী সুরক্ষা যোজনা। এই আট বছরে কী অবস্থায় দাঁড়িয়ে এই প্রকল্পটি? কমন রিভিউ মিশনের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার বেড়েছে। নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে আগের তুলনায় সচেতনতাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু তবুও এই প্রকল্পে বরাদ্দ কেন্দ্রীয় অর্থ যথাযথ ভাবে খরচ করতে ব্যর্থ রাজ্য সরকার। বেশ কয়েকটি জেলা বরাদ্দ অর্থ খরচ করতে না পারায় রাজ্য সরকারকে দফায় দফায় হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
একই ছবি জয়েন্ট রিভিউ কমিশনের রিপোর্টেও। সেখানে মন্তব্য করা হয়েছে, প্রসূতিরা তাঁদের প্রাপ্য ভাতা পাচ্ছেন না। মাসের পর মাস, কখনও কখনও বছর গড়িয়ে যাচ্ছে। সমস্যার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছলেও তা মেটানোর কোনও চেষ্টা নেই। নিখরচায় প্রসূতিদের যাতায়াতের ব্যস্থা করতে ‘নিশ্চয় যান’ প্রকল্পও ব্যর্থ বলেই অভিযোগ। বহু ক্ষেত্রে এমন অভিযোগও এসেছে যে নিশ্চয় যানের চালক প্রসূতিকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে বা হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এনে টাকা দাবি করেছেন এবং বহু ক্ষেত্রে তা মেটাতেও হয়েছে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে। অভিযোগ জানিয়েও ফল হয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন ৫০০ টাকা এবং প্রসবের সময়ে আরও ২০০ টাকা দেওয়ার কথা। কোনও রাজ্য চাইলে এর সঙ্গে নিজস্ব খাতের অর্থ মিলিয়ে অঙ্কটা কিছুটা বাড়াতে পারে। এ রাজ্যে সব মিলিয়ে অঙ্কটা ১০০০ টাকা। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষকর্তার অনুযোগ, “সত্যিই কি ওই টাকায় গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টি সম্ভব? তামিলনাড়ু নিজস্ব খাত থেকে ওই অঙ্ক অনেকটাই বাড়িয়ে নিয়েছে। সেখানে ‘কমিউনিটি সাধভক্ষণ’ হয়। প্রসূতিদের ভালমন্দ খাওয়ানোর পাশাপাশি ওই সময়ে তাঁদের কী ভাবে চলা উচিত, সন্তান জন্মের পরে কী ভাবে তার যত্ন নেওয়া উচিত, সেটাও শেখানো হয়। এ রাজ্যে স্রেফ টাকা দিয়ে দায়িত্ব শেষ হচ্ছে। তাও সেই টাকা সময় মতো পাচ্ছেন না অনেকেই।”
গর্ভাবস্থায় প্রসূতিদের পুষ্টির ব্যবস্থা করতে পুরুলিয়ায় মহিলাদের জন্য বিশেষ লাড্ডুর প্যাকেট বিলির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যেই পুষ্টির বিভিন্ন উপাদান মেশানো থাকে। চালু হওয়ার কয়েক মাস পরে সেই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। কেন এমন হাল? তাঁর ব্যাখ্যা, “জননী সুরক্ষা যোজনা যে আর পাঁচটা প্রকল্পের চেয়ে আলাদা, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব যে অনেক বেশি, সেই বোধটাই তৈরি করা যায়নি।”