ঘাটবেড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গায়ে সেই বিজ্ঞপ্তি। —ফাইল চিত্র।
ঘটনা ১: স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছে লেখাটা: ‘এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে যে সমস্ত রোগীরা ওষুধ নেবেন, তাঁদের ওষুধপত্র নিতে হবে নিজ দায়িত্বে। কারণ, এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিত্সক নেই। রোগী দেখা ও ওষুধ দেওয়ার দায়িত্বে ফার্মাসিস্ট ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা’। পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের বলরামপুর ব্লকের ঘাটবেড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দেওয়ালে কিছুদিন আগে পর্যন্তও এমন বিজ্ঞপ্তি সাঁটানো ছিল।
ঘটনা ২: কোটশিলা গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এক সকালে রোগীরা পৌঁছে দেখেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিত্সক নেই। মাঝে মাঝেই এখানে ডাক্তার থাকেন না। অবিলম্বে এখানে চিকিত্সক নিয়োগ করার দাবিতে পুরুলিয়া-রাঁচি সড়ক অবরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এই ঘটনা কয়েক মাস আগের।
ঘটনা ৩: মাঠে খেলা করার সময় এক বালকের পায়ে বড় কাঁটা ফুটলে বাড়ির লোকজন ছেলেটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন ঝালদা ১ ব্লকের মাহাতোমারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানেও চিকিত্সক নেই। চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা জানিয়ে দেন, সামান্য হলেও বালকের পায়ে অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিন্তু চিকিত্সক না থাকায় তা সম্ভব নয়। কাঁটা বের করতে হলে নিয়ে যেতে হবে ঝালদা সদরে। স্থানীয় বিধায়ক নেপাল মাহাতো ঘটনার কথা জেনে অত্যন্ত গরিব পরিবারের ওই বালকটিকে ঝালদা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
ঘাটবেড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কোটশিলা গ্রামীণ হাসপাতাল বা মাহাতোমারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এই ছবি কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই এক ছবি। কমবেশি সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রই ধুঁকছে চিকিত্সক সঙ্কটে। স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রশ্নে এই ছবির সঙ্গেই মিল রয়েছে ঝালদা ১ ব্লকের ইলু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের। স্থানীয় বাসিন্দা শঙ্কর মাহাতো জানান, ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাঝে মাঝেই চিকিত্সক থাকেন না। ফার্মাসিস্ট বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরাই রোগী দেখেন। জেলা স্বাস্থ্য দফতরে অনেক বার এই সমস্যার কথা জানানো হলেও অবস্থার কোনও হেরফের হয়নি। কোথাও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে বেহাল পরিষেবার অভিযোগে স্বাস্থ্যকর্তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘেরাও হয়ে থাকার ঘটনাও রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার না থাকায় তাঁরা চিকিত্সা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কোথাও আবার এক জন চিকিত্সক দু’টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকায় দু’টি জায়গাতেই পরিষেবা মার খাচ্ছে।
অবশেষে এই ছবি পাল্টাতে চলেছে বলে মনে করছেন জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা। পুরুলিয়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষ জানিয়েছেন, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর পুরুলিয়ার জন্য ৮৭ জন চিকিত্সক নিয়োগের কথা জানিয়েছে। সম্প্রতি তাঁরা সেই নির্দেশ হাতে পেয়েছেন। যদিও জেলায় এই মুহূর্তে চিকিত্সকদের ৯৮টি শূন্যপদ রয়েছে বলে জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর।
তবে, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ৮৭ জন চিকিত্সককে পুরুলিয়ায় নিয়োগ করলেও ঠিক কত জন শেষ অবধি কাজে যোগ দেবেন, তা নিয়ে সন্দিহান জেলা স্বাস্থ্য দফতরের একাধিক কর্তা। তাঁদের কথায়, “পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে অ্যানাস্থেটিস্টের আকাল দেখা দেওয়ায় জরুরি অস্ত্রোপচার ব্যাহত হচ্ছিল। জেলার একমাত্র বড় হাসপাতালে অস্ত্রোপচার প্রায় বন্ধ হতে বসায় (জরুরি অস্ত্রোপচার ছাড়া) রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এক জন অ্যানাস্থেটিস্টকে পুরুলিয়া সদর পাঠালেও তিনি এখানে যোগ দেননি।” চিকিত্সকদের ক্ষেত্রেও একই রকম অভিজ্ঞতা হবে বলে তাঁদের ধারণা। ওই স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের শেষে চিকিত্সক নিয়োগের নির্দেশ জারি হলেও এখনও অবধি মাত্র ১৫ জন যোগ দিয়েছেন। মানবেন্দ্রবাবু অবশ্য বলেছেন, “আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাজে যোগ দেওয়ার সময়সীমা রয়েছে। আমরা আশাবাদী, এই ৮৭ জনের বেশির ভাগ চিকিত্সকই গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও প্রাথমিক স্বাস্থকেন্দ্রে যোগ দেবেন।” সকলে যদি শেষ পর্যন্ত যোগ নাও দেন, তবু পুরুলিয়ার চিকিত্সক সঙ্কট অনেকটাই অভাব মিটবে বলে মনে করেন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক।