কয়েক লক্ষ টাকার স্বাস্থ্য বিমা করা রয়েছে। ফি-বছর সে জন্য প্রিমিয়ামও দেন। কিন্তু কোনও একটা জটিল রোগ নির্ণয়ের জন্য বেশ কিছু দামি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ল। তখন সেই খরচ বিমা সংস্থার থেকে চাইতে গেলে তারা মুখ ফেরায়। সাধারণত সেই খরচ তারা দেয় না। কারণ তাদের যুক্তি, আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। অতএব আপনি চিকিৎসার খরচ পাবেন না।
কিংবা ধরা যাক, কোনও এক জন ক্যানসার রোগী। কয়েক লাখ টাকার কেমোথেরাপি নিতে হচ্ছে। কিন্তু বিমা সংস্থা তাঁকে এক টাকাও ঠেকাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রেও কারণ একটাই। তাঁর হাসপাতালবাস হচ্ছে না যে!
স্বাস্থ্য বিমার চেনা হয়রানির এই ছবি এ বার বদলাতে চলেছে। বৃহস্পতিবার গোয়ায় এক স্বাস্থ্য সম্মেলনে এই প্রতিশ্রুতি দিলেন সরকারি-বেসরকারি বিমা সংস্থার কর্তারা। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকার কথা ছিল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর আসা বাতিল হয়। তবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে খবর, হাসপাতালে ভর্তি হলে তবেই চিকিৎসার খরচ মিলবে, এমন নীতি বদলানোর কথা ভাবা হচ্ছে। শুধু রোগ হলে তার চিকিৎসা নয়। রোগকে ঠেকানোর জন্য যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয় (প্রিভেনটিভ ট্রিটমেন্ট) তার উপরেও জোর দেওয়া হচ্ছে। শুধু মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত নয়। মন্ত্রকের শীর্ষ কর্তাদের মতে, কত বেশি সংখ্যক মানুষকে এর আওতায় আনা যায়, সেটাই মোদী সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
গত জুন মাসে আমেরিকায় গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সেখানে প্রবাসী ভারতীয় চিকিৎসকদের সভায় তিনি জানিয়েছিলেন, বারাক ওবামার ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’-র নীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতেও সব আর্থিক স্তরের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য বিমা চালু করতে চলেছেন তাঁরা। আমেরিকায় যেমন ‘ওবামা কেয়ার’, ভারতেও তেমনি ‘মোদী কেয়ার’। আর তার ‘ব্লু-প্রিন্টও’ তৈরি। মোদী সরকারের এই নয়া বিমা নীতির পোশাকি নাম ‘ইউনির্ভাসাল হেলথ অ্যাসিওরেন্স প্রোগ্রাম’। এর রূপরেখা তৈরির জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হয়েছিল গত মাসে। তার রিপোর্টও জমা পড়ে গিয়েছে। এ বার শুধু সেই নয়া নীতি মন্ত্রিসভায় পাশ করানোর পালা।
টেলিফোনে এ দিন হর্ষ বর্ধন জানিয়েছেন, ৫০টি অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং একই সংখ্যক জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ যাতে কোনও সংস্থাই কোনও ভাবে আটকাতে না পারে, তার ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই তৈরি। তিনি বলেন “অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের সঙ্গে এক প্রস্ত কথা হয়েছে। যে সব বিমা সংস্থা সরকারি প্রস্তাবে রাজি হবে, তাদের জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করবে সরকার। ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, ক্যানসারের মতো অসুখ থাকলে যাতে বিমা করাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সেটাও দেখা হবে।” তবে এ ক্ষেত্রে যে আশঙ্কা রয়েছে, তা হল বিমা সংস্থা এই সুযোগে আবার গ্রাহকদের থেকে প্রিমিয়ামের পরিমাণ বাড়াতে পারে।
‘পেশেন্ট প্রোটেকশন অ্যান্ড অ্যাফর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’-এর বা সংক্ষেপে ওবামা কেয়ারের মূল কথা হল, সেরা চিকিৎসা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া এবং চিকিৎসা খাতে আম জনতার ব্যয় কমানো। ভারতেও এই একই ধাঁচে সমস্ত স্তরে চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার কথা জানান হর্ষ বর্ধন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দু’টি প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, ওবামা কেয়ার নিয়ে মার্কিন মুলুকে কম বিতর্ক হচ্ছে না। সাধারণ মানুষকে সুযোগ-সুবিধা দিতে গিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা শিল্পকে অনেকটাই ধাক্কা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে সেখানে। এখানেও তেমন কিছু হবে না তো? হর্ষ বর্ধনের আশ্বাস, তাঁরা দু’পক্ষের স্বার্থই দেখবেন।
দ্বিতীয়ত, ভারতে ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা চালু হয়েছে। এই যোজনায় গরিব মানুষের হাতে পৌঁছেছে একটি করে কার্ড। তা দেখিয়ে তাঁরা সরকারি বা সরকারি তালিকাভুক্ত বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পরিবারপিছু ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসার খরচ পাওয়ার কথা। নতুন নীতিতে গরিবের জন্য কোনও বাড়তি সংযোজন হবে?
হর্ষ বর্ধন জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনায় কিছু ফাঁক-ফোকর রয়েছে। গরিব মানুষের ‘কোয়ালিটি’ চিকিৎসা এখনও অধরাই।
তাঁরাও যাতে ভাল হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সেরা চিকিৎসা পান, তার দায় নেবে সরকার।
ভারতের জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ এখন স্বাস্থ্য বিমার আওতায় রয়েছে। আর মাত্র ২.২ শতাংশ রয়েছে বেসরকারি সংস্থার বিমার আওতায়। গ্রামাঞ্চলে এই অবস্থাটা আরও ভয়াবহ। কেন্দ্রীয় সরকারের মতে, স্বাস্থ্য বিমার ছবিটা না বদলালে ভারতের এই হেলে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে দাঁড় করানো সম্ভব নয়। তাই স্বাস্থ্য বিমাকে কী ভাবে আরও জনমুখী করে তোলা যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন দেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিমা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ডি জে শাহ, অনুজ গুলাটি, সঞ্জয় দত্তের মতো ব্যক্তিত্বরা।
কিন্তু এখানেও একটা প্রশ্ন রয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অনেকেরই বক্তব্য, ‘ইউনির্ভাসাল হেলথ অ্যাসিওরেন্স’-এর নাম করে বিমার সামগ্রিক বেসরকারিকরণের প্রয়াস চলছে না তো? এর ফলে বিপুল সংখ্যক গ্রাহক পেয়ে বিমা সংস্থাগুলির ব্যবসা হয়তো ফুলেফেঁপে উঠবে। কিন্তু সাধারণ গরিব মানুষের হয়রানি কি কমবে? বিমা করানো থাকলে ডাক্তাররা যথেচ্ছ অস্ত্রোপচার করেন। বেসরকারি হাসপাতাল খুশিমতো বিল বাড়ায়। এই অভিজ্ঞতা তো সাধারণ মানুষের রয়েছেই। সকলের জন্য নয়া স্বাস্থ্য বিমার নীতি সেই দুর্ভোগকে আরও বাড়াবে না তো? হর্ষ বর্ধনের আশ্বাস, কোনও রকম দুর্নীতি কিংবা অসততা যাতে না করা হয় তার জন্য একাধিক রক্ষাকবচ থাকবে। এ ছাড়াও থাকবে নিয়ন্ত্রক কমিটি। কিন্তু তাঁরা ঠিক কী ভাবে কাজ করবে, তার ব্যাখ্যা তিনি এ দিন দিতে পারেননি।