অভিযোগ ছিল, ঠিক সময়ে এনসেফ্যালাইটিস সংক্রান্ত ঠিক তথ্য উচ্চতর প্রশাসনকে জানানো হয়নি। তার জেরে গত এগারো দিনে মোট দু’দফায় চার স্বাস্থ্য-কর্তাকে নবান্ন সাসপেন্ড করেছে, বদলি হয়েছেন এক জন। কিন্তু তথ্য গোপনের প্রবণতায় তাতেও কি লাগাম দেওয়া গিয়েছে?
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও আশপাশে জ্বর-আক্রান্তের খতিয়ান সন্ধান করতে গেলে প্রশ্নটা জাগতে বাধ্য। মেডিক্যাল কলেজ-কর্তৃপক্ষের দাবি: ১ অগস্ট থেকে ৬ অগস্ট পর্যন্ত জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হয়ে এখানে মারা গিয়েছেন তিন জন অর্জুন সিংহ, রোমা বর্মন ও কুলসুন্নেসা বেগম। অথচ ব্লক ও অন্যান্য হাসপাতাল-সূত্রে জানা যাচ্ছে, ওই সময়ে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের। বস্তুত মৃতদের নিবাস-অঞ্চলে মশা নিধন ও শুয়োর হটানোর অভিযানে সংশ্লিষ্ট ব্লক স্বাস্থ্য দফতর ঝাঁপিয়ে পড়তেই আড়ালে রাখা মৃত্যুর হিসেব সামনে এসে পড়েছে।
যেমন, বুধবার ভোরে বাগডোগরার অদূরে এমএম তরাই চা বাগানের বাসিন্দা অশোক গুরুঙ্গের (৫৯) মৃত্যু। ব্যাংডুবির সেনা হাসপাতালে তিনি মারা গিয়েছেন। মেডিক্যাল থেকেই তাঁর রক্ত পরীক্ষা করিয়ে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ধরা পড়েছিল। ১ অগস্ট ফাঁসিদেওয়ার পাহাড়গুমিয়ার মারা গিয়েছেন অজিত কুজুর (৫৫), যিনি জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে ভুগছিলেন বলে স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়ে দিয়েছেন বাড়ির লোককে। স্বাস্থ্য দফতরের তরফে অবশ্য এই দু’টি মৃত্যুর কথা এ দিন রাত পর্যন্ত স্বীকার করা হয়নি। যদিও দুপুর গড়াতেই এমএম তরাই ও পাহাড়গুমিয়ায় মশা নিধন ও শুয়োর তাড়ানোর অভিযান শুরু হয়ে গিয়েছে জোর কদমে।
রোগ প্রতিরোধ রুখতে যেখানে সতর্কতা ও প্রচার সবচেয়ে জরুরি, যেখানে উত্তরবঙ্গের প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে সচেতনতা-প্রচার খাতে লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে রাখা হয়েছে, সেখানে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় কেন?
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের এক কর্তার ব্যাখ্যা: সংবাদ মাধ্যমে তথ্য-পরিসংখ্যান দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের উপরে মৌখিক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। তবে ওঁরা একান্তে মানছেন, বিষয়টি যত বেশি প্রচারে আসবে, মানুষ তত সচেতন হবে। অথচ জেলার অনেক স্বাস্থ্যকর্মীরও আক্ষেপ, তাঁদের মুখ খুলতে বারণ করা হচ্ছে। এনসেফ্যালাইটিসের তথ্য যাতে ‘মিডিয়া’র কাছে না পৌঁছায়, সে ব্যাপারে উপরমহল থেকে ‘সাবধান’ করে দেওয়া হচ্ছে বারবার।
বাস্তব চিত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে লুকোছাপার এ হেন অভিযোগ পৌঁছেছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী তথা মেডিক্যাল কলেজের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান গৌতম দেবের কানেও। হাসপাতাল-সূত্রের খবর, আজ, বৃহস্পতিবার বেলা দশটায় তিনি মেডিক্যাল কলেজে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। সেখানে তিনি রোগ সংক্রান্ত স্পষ্ট তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়ে কথা বলবেন। “নানা এলাকার অনেক তথ্য আমার কাছে এসেছে। সব নজরে রয়েছে। যেখানে যা জানানোর, জানাচ্ছি। মনে রাখতে হবে, মুখ্যমন্ত্রী স্বচ্ছতায় বিশ্বাসী বলেই এনসেফ্যালাইটিসের বিষয়টি দেরিতে জানানোর জন্য কড়া পদক্ষেপ করেছেন।” এ দিন মন্তব্য গৌতমবাবুর। তাঁর আশ্বাস, “বৈঠকে সব কিছু নিয়েই আলোচনা হবে।”
ঘটনা হল, মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা সংক্রান্ত অভিযোগের বহরেও কমতি নেই। এ দিন মারা গিয়েছেন গোয়ালপোখরের অর্জুন সিংহ (২৩) ও মেখলিগঞ্জের স্বপ্না বর্মন (১৩)। এনসেফ্যালাইটিস-উপসর্গের রোগী বানারহাটের জয়া শৈবেরও মৃত্যু হয়েছে। গত সোমবার জলপাইগুড়ি হাসপাতালে ওই বধূটিকে ভর্তি করানো হয়েছিল। অভিযোগ, সেখানে ঠিকঠাক চিকিৎসা হয়নি। প্রথমে মেঝেয় শয্যা, পরে অন্য রোগীর বেডে, তার সঙ্গে। জয়ার শাশুড়ি লক্ষ্মীর অভিযোগ, পরীক্ষার জন্য রক্ত পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। “ডাক্তারবাবু আর নার্সরা আমাদের বলছিলেন যেন বাইরে মুখ না-খুলি। ধমক দিচ্ছিলেন।” জানান বৃদ্ধা। যাঁর আক্ষেপ, “মেডিক্যালে এনেও বৌমার ঠিক চিকিৎসা হল না। তার উপরে ডাক্তারবাবু বললেন, বডি সোজা বাড়ি নিয়ে যান, কারও সঙ্গে কথা বলবেন না!”
এত লুকোছাপা কেন, স্বভাবতই ছোপোষা মহিলার তা মাথায় ঢুকছে না। হাসপাতাল কী বলছে? বিশেষত মৃত্যুর সরকারি পরিসংখ্যান ও বাস্তব খতিয়ানে ফারাক কেন?
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের সুপার সব্যসাচী দাস রোগী-মৃত্যুর পরিসংখ্যান প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি। “যা বলার, স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বলবেন।” জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য-আধিকারিক ও তাঁর দফতরও নীরব। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “হিসেবে গরমিল হতেই পারে। হয়তো সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য-আধিকারিকেরা এখনও কলকাতার অফিসে সব মৃত্যুর খবর পাঠাতে পারেননি। পাঠিয়ে দেবেন।” পাশাপাশি উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিস উপসর্গের দাপট কমছে বলে দাবি করে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা এ-ও ঘোষণা করেছেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।”
এ দিনও অবশ্য উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের ‘ফিভার ক্লিনিকে’ ভিড় করেছেন শতাধিক মানুষ। তাঁদের মধ্যে জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের বাসিন্দাও ছিলেন।
সহ প্রতিবেদন: সৌমিত্র কুণ্ডু।