প্রভাত বেনিয়া
কিডনিতে ছ’কেজি ওজনের টিউমার ছিল ন’বছরের ছেলের। ডাক্তারেরা জানিয়েছিলেন, স্টেজ ফোর ক্যানসার। অস্ত্রোপচার করে টিউমারটি বাদ দেওয়া হল ঠিকই, কিন্তু বিপদ কাটল না। ঠাকুরপুকুরের এক হাসপাতালে ছেলেকে ভর্তি করে দিয়ে তার বাবা তাদের সঙ্গ ত্যাগ করলেন। ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়েও বাধা পেলেন মা। কারণ তাঁর স্বামী তো বটেই, আশপাশের বাসিন্দারাও জানিয়ে দিলেন, এমন ছোঁয়াচে রোগের ছেলেকে এলাকায় থাকতে দেবেন না তাঁরা। এতে তাঁদেরও বিপদ বাড়বে। কোনও প্রত্যন্ত গ্রাম নয়, খাস দক্ষিণ কলকাতার পণ্ডিতিয়া বস্তির এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এ রাজ্যে ক্যানসার সচেতনতার ছবিটা এখনও কোন তলানিতে।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে কোথাও ঠাঁই না পেয়ে ফের হাসপাতালেরই দ্বারস্থ হয়েছিলেন ছেলেটির মা। আশ্রয়ও জুটেছিল। কিন্তু মাস চারেকের বেশি বাঁচানো যায়নি প্রভাত বেনিয়া নামে ওই বালককে।
যক্ষ্মা বা কুষ্ঠ রোগ নিয়ে এমন ছুঁৎমার্গের ঘটনা আকছার শোনা যায়। কিন্তু ক্যানসারকে ঘিরেও যে ভ্রান্ত ধারণার কোনও শেষ নেই, প্রভাতের ঘটনাই তার প্রমাণ। জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রি অনুযায়ী, প্রতি বছর গোটা দেশে প্রায় ৪৫ হাজার শিশু ও কিশোর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশই এ রাজ্যের। কিন্তু তার পরেও এই রোগ নিয়ে সে ভাবে কোনও সচেতনতা তৈরি হয়নি।
বাড়িতে ঠাঁই না পাওয়ার পরে প্রভাত ও তার মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ওই সংগঠনের তরফে পার্থ সরকার বলেন, “শিশুটির এমন পরিণতি কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। সেই কারণে আমাদের মনে হয়েছিল সচেতনতা বাড়ানোর জন্য উদ্যোগী হওয়া জরুরি। শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের নিয়ে তাই একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলাম আমরা। তার ফলাফলও সচেতনতার ভয়াবহ অবস্থাটাই তুলে ধরেছে।”
কী পাওয়া গিয়েছে সেই সমীক্ষায়? পার্থবাবু জানিয়েছেন, এক হাজার জন অভিভাবককে নিয়ে ওই সমীক্ষা হয়েছিল। যাঁদের একটা বড় অংশই জানিয়েছেন, ক্যানসার রোগটা মূলত প্রায়প্তবয়স্কদের হয়, শিশুদের হয় না। রক্তের সম্পর্কে ক্যানসার ছড়ায় বেশি, ক্যানসার রোগটা ছোঁয়াচে। শিশুদের ক্যানসার হলে তার কোনও চিকিৎসা নেই, কেমোথেরাপি করানো খুব খারাপ, বায়োপসি করালে ক্যানসার ছড়িয়ে যায় এমন ধারণাও রয়েছে একটা বড় অংশের অভিভাবকদের।
প্রভাতের বাবা এখন কোথায় থাকেন, তার হদিস কারও কাছে নেই। পণ্ডিতিয়া বস্তির একাধিক বাসিন্দাই জানিয়েছেন, প্রভাতকে তাঁরা ভালবাসতেন ঠিকই, কিন্তু নিজেদের সম্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওই ‘ছোঁয়াচে’ রোগের ছেলেটিকে তাঁরা বস্তিতে ঠাঁই দিতে চাননি। পার্থবাবুর মতে, সমীক্ষায় অংশ নেওয়া অভিভাবকদের সঙ্গে এঁদের মানসিকতার বিশেষ তফাত নেই। তাই বদলটা সব স্তরেই জরুরি।
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, “শিশুদের ক্যানসার যে হারে বাড়ছে, তাতে অভিভাবকেরা সচেতন না হলে বড়সড় খেসারত দিতে হতে পারে শিশুটিকে। বহু ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি, কোনও শিশুর হয়তো ঘন ঘন জ্বর হচ্ছে, ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, খিদে নেই, ঝিমিয়ে থাকছে, অথচ বাড়ির লোকেরা বিষয়টাকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বরং নানা রকম টোটকা বা বিকল্প পদ্ধতির চিকিৎসা করাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত যখন তাঁরা ডাক্তারের কাছে পৌঁছচ্ছেন, বহু ক্ষেত্রেই ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।”
একই কথা বলেছেন ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, “বড়দের ক্ষেত্রে ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে সচেতনতা মারাত্মক কম। বাবা-মা মানতেই চান না যে বাচ্চাদের ক্যানসার হতে পারে। অথচ বাচ্চাদের লিম্ফ নোড-এর ক্যানসার ও রক্তের ক্যানসার খুব বেশি হয়। জন্মগত কিছু ক্যানসার, যেমন চোখের ক্যানসারও হয়।”
ক্যানসার চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়ও জানালেন, তাঁর কাছে বহু অভিভাবকই ক্যানসার আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে আসেন, খানিকটা আগে এলে যাদের চিকিৎসায় আরও ভাল ফল মিলতে পারত।