রক্ত আছে, দেবে কে? ধুঁকে ধুঁকে মরল মেয়েটা

ডাক্তারেরা বাড়ির লোককে বলেছিলেন, “তাড়াতাড়ি রক্ত জোগাড় করুন।” বারো বছরের মেয়েটা বাবাকে বলেছিল, “তোমরা কেঁদো না। রক্ত দিলেই আমি ভাল হয়ে যাব।’’ তড়িঘড়ি চার বোতল রক্তের ব্যবস্থাও হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই রক্ত দিয়ে ওঠা যায়নি। বৃহস্পতিবার সকালে স্রেফ রক্ত না পেয়েই মারা গেল সুহানা ইয়াসমিন মণ্ডল নামে ওই কিশোরী। কোনও গ্রামীণ হাসপাতাল নয়, রাজ্যের একমাত্র সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমের ঘটনা। রক্ত জোগাড় হওয়া সত্ত্বেও কেন রক্ত দেওয়া গেল না ওই কিশোরীকে?

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৪৪
Share:

তখনও বেঁচে সুহানা (ইনসেটে)। বৃহস্পতিবার।—নিজস্ব চিত্র।

ডাক্তারেরা বাড়ির লোককে বলেছিলেন, “তাড়াতাড়ি রক্ত জোগাড় করুন।” বারো বছরের মেয়েটা বাবাকে বলেছিল, “তোমরা কেঁদো না। রক্ত দিলেই আমি ভাল হয়ে যাব।’’ তড়িঘড়ি চার বোতল রক্তের ব্যবস্থাও হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই রক্ত দিয়ে ওঠা যায়নি।

Advertisement

বৃহস্পতিবার সকালে স্রেফ রক্ত না পেয়েই মারা গেল সুহানা ইয়াসমিন মণ্ডল নামে ওই কিশোরী। কোনও গ্রামীণ হাসপাতাল নয়, রাজ্যের একমাত্র সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমের ঘটনা।

রক্ত জোগাড় হওয়া সত্ত্বেও কেন রক্ত দেওয়া গেল না ওই কিশোরীকে?

Advertisement

প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, সুহানাকে রক্ত দেওয়ার সময়ই নাকি পাননি ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা। কে রক্ত দেবেন, তা নিয়ে ডাক্তারদের একাংশের পারস্পরিক দায় চাপানোর মধ্যে পড়েই রক্ত না-পেয়ে মরতে হল ওই কিশোরীকে। এসএসকেএমের সুপার দীপাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তদন্ত হবে। তাঁর কথায়, “মেয়েটি কেন মারা গেল তা জানা আমাদের পক্ষেও খুব জরুরি। যদি হাসপাতালের কারও গাফিলতি প্রমাণিত হয়, তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি কোনও গাফিলতির কারণে ১২ বছরের একটি মেয়ের মৃত্যু হয়ে থাকে, তা মেনে নেওয়া আমাদের পক্ষেও বেদনার।”

যেখানে মেয়েটি ভর্তি ছিল, সেই প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক বিজয় মজুমদার বলেছেন, “কেন রক্ত দিতে দেরি হল, সেটা খোঁজ নিচ্ছি। মেয়েটির শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল বলেই হয়তো ডাক্তাররা রক্ত দিতে চাননি। অবস্থা স্থিতিশীল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।” অবস্থা স্থিতিশীল হতে গিয়ে মেয়েটির মৃত্যু হবে সেটা ডাক্তাররা বুঝতে পারেননি? প্রশ্নের জবাব ছিল না বিজয়বাবুর কাছে।

সুহানার শ্বাসকষ্ট কি বরাবরই ছিল? ওয়ার্ডের নার্সরা জানিয়েছেন, বুধবার দিনভর সুহানার কোনও শ্বাসকষ্ট ছিল না। শ্বাসকষ্ট শুরু হয় বৃহস্পতিবার সকালে। এক নার্সের কথায়, “আমরা অনেকেই বুধবার দিনভর ডাক্তারকে ফোন করেছিলাম। বেশ কয়েক বার ফোনে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেল, উনি জানালেন, ব্যস্ত আছেন। বৃহস্পতিবার এসে যা করার করবেন। আমার জানিয়েছিলাম যে মেয়েটির অবস্থার অবনতি হচ্ছে।”

বুধবার রাত পর্যন্ত বাড়ির লোকের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছিল সুহানা। খাওয়াদাওয়া করেছিল। তার বাড়ির লোকেরাও শ্বাসকষ্ট দেখতে পাননি। বুধবার বিকেলে সুহানা নিজেই তার বাবা নুরুল আমিনের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “আমার দুর্বল লাগছে। তবে তোমরা কেঁদো না, রক্ত দিলেই ঠিক সেরে উঠব।”

কী হয়েছিল সুহানার?

সুহানার বাড়ি উত্তর ২৪ পরগণার স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়ায়। সুহানার জেঠু রেজাউল মণ্ডল বলেন, মঙ্গলবার স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি লোহার রড বোঝাই ভ্যান ধাক্কা মারে মেয়েটিকে। হাতে, কোমরে গুরুতর চোট লাগে। বসিরহাট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে সুহানাকে রেফার করা হয় আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে।

সুপারিশ ছাড়া জেলা থেকে আসা যে কোনও রোগীকে কলকাতার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে কী কাঠখড় পোড়াতে হয়, তা জানা ছিল সুহানার অভিভাবকদেরও। কিন্তু স্রেফ কপাল ঠুকেই তাঁরা রক্তাক্ত মেয়েটিকে নিয়ে আসেন কলকাতায়। রেজাউলের অভিযোগ, আরজিকর হাসপাতালে ন্যূনতম চিকিৎসা ছাড়াই মেয়েটিকে রেফার করা হয় এসএসকেএমে। সেখানে আনা হলে চিকিৎসকেরা বলেন, সুহানার অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। মঙ্গলবার রাতে এসএসকেএমের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের অধীনে অ্যালেক্স ওয়ার্ডে ভর্তি হয় মেয়েটি। তার ক্ষতস্থানে সেলাই হয়। শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে বলে পরদিন সকালে ডাক্তাররাই জানান, দ্রুত চার ইউনিট রক্ত লাগবে।

রেজাউল বলেন, “বুধবার দুপুর ১২টার মধ্যে চার ইউনিট রক্ত এনে দিয়েছি। প্রথমে তা রিসিভ করবার জন্য যে খাতা ব্যবহার হয়, সেটাই নার্সরা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বহু কষ্টে খাতা পাওয়া গেল, কিন্তু ডাক্তারবাবুকে পাওয়া গেল না। চোখের সামনে দেখলাম, মেয়েটা নেতিয়ে পড়ছে। হাতেপায়ে ধরেছি। কিন্তু কাজ হয়নি।”

অভিযোগ ওয়ার্ডে নার্স ছিলেন, চিকিৎসক ছিলেন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা ছিলেন, বড় ডাক্তার এসে ঘুরেও গিয়েছেন। কিন্তু সুহানার শয্যার পাশে চার ইউনিট রক্ত পড়ে থেকেছে অব্যবহৃত অবস্থাতেই। কেন?

নিয়ম অনুযায়ী রোগীকে রক্ত দেওয়ার সময় ডাক্তারকে প্রয়োজন। কর্তব্যরত নার্স এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের কেউ কেউ জানান, ওয়ার্ডের অধিকাংশ ডাক্তার স্নাতকোত্তর স্তরের পড়ুয়া। তাঁরা পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। রোগীর দিকে খুব একটা দৃষ্টি দেন না। ফলে যা করার নার্স ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরাই করেন। এক নার্সের কথায়, “রক্ত দেওয়ার সময়ে ডাক্তারের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক না হলে, আমরা দিয়েই দিতাম।”

এ দিন বিকেলে এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গের সামনে সুহানার জেঠু কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মেয়েটা মরে গেল। বিশ্বাসই করতে পারছি না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement