সন্তান কোলে শুক্লাদেবী। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
জড়োসড়ো ভঙ্গিতে ফুটফুটে, একরত্তি শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন শুক্লা রায়। সবে তাকে হাসপাতালের কেবিনে মায়ের কোলে দেওয়া হয়েছে। দিব্যি চোখ পিটপিট করছে। সে দিকে তাকিয়ে চোখ জলে ভরে এল প্রৌঢ়ার।
যখন নাতি-নাতনিকে নিয়ে খেলা করার, তখনই কোলে সন্তান এসেছে। পুজোর মুখেই বাবা-মা হয়েছেন ৫৯-র শুক্লা আর ৬৮ বছরের বিকাশবন্ধু রায়। ১৪ মাস আগে একমাত্র সন্তানের মৃত্যু যে পরিবারকে স্থবির করে দিয়েছিল, সেখানে এখন উৎসবের মেজাজ।
মাস কয়েক আগে এই শহরেই মা হয়েছেন ৫৬ বছরের এক মহিলা। তখনই তাক লেগে গিয়েছিল অনেকের। শুক্লাদেবী যেখানে ভর্তি রয়েছেন, পার্ক স্ট্রিটের সেই হাসপাতালে ৫৯-এর মাকে ঘিরে এখন সকলেই প্রবল উৎসাহী।
দুর্গাপুরে সপরিবার থাকতেন সেচ দফতরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী বিকাশবন্ধু। ২০১৩-র ২৫ জুন বর্ধমানের কাছে তালিত স্টেশনে ট্রেন থেকে পড়ে মৃত্যু হয় তাঁদের একমাত্র সন্তান পল্লবীর। কিন্তু সেখানেই সবটা শেষ হয়ে যেতে দেননি শুক্লা। দুর্গাপুরের পাট চুকিয়ে কলকাতায় আসেন। সন্তান লালনের বাসনা তাঁকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। পরিচিত অনেকেই দত্তক নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু শুক্লাদেবীর এক গো। নিজের শরীরে লালন করা সন্তানই চাই তাঁর। তা কী ভাবে সম্ভব? আট বছর আগে মেনোপজ হয়েছে। অগস্টেই কলকাতায় স্ত্রীরোগ চিকিৎসক গৌতম খাস্তগীরের কাছে গেলেন। গৌতমবাবু জানালেন, সন্তানধারণ সম্ভব। কিন্তু অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। শুক্লাদেবী জানালেন, তিনি সব কিছুর জন্য প্রস্তুত।
গোড়ায় শুক্লার স্বামী বিষয়টিকে সমর্থন করেননি। মেয়ের জন্মের আগে একটি সন্তান শেষ পর্যায়ে গর্ভে মারা গিয়েছিল। বিকাশবন্ধুবাবুর বক্তব্য ছিল, “দু’দু’বার তো সন্তান এসেছিল। তাদের রাখা যায়নি। তাই যেচে শোক আনার দরকার নেই।” কিন্তু দমাতে পারেননি স্ত্রীকে। শেষে রাজি হন।
শুক্লাদেবীর ভ্রাতৃবধূ চন্দনা মুখোপাধ্যায় বলেন, “দিদির পাশে না থাকলে ওর নানা মানসিক সমস্যা দেখা দেবে, বুঝতে পেরেছিলাম। তাই জানিয়েছিলাম, পাশে থাকব। অক্টোবর থেকে শুরু হয় চিকিৎসা। জানুয়ারিতে গর্ভে ভ্রূণ প্রতিস্থাপিত হয়। আর সেপ্টেম্বরে সন্তানের জন্ম।”
চিকিৎসক গৌতমবাবু জানান, অন্য এক মহিলার থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে শুক্লাদেবীর স্বামীর শুক্রাণুর সঙ্গে তা নিষিক্ত করা হয়। তার পরে ভ্রূণ আকারে সেটি প্রতিস্থাপন করা হয় শুক্লাদেবীর জরায়ুতে। তাঁর কথায়, “প্রথম দিকে কিছু জটিলতা ছিল। শেষ এক মাসও নানা পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য ওঁকে হাসপাতালে ভর্তি রেখেছিলাম। সন্তান হারানো এক দম্পতির কোলে সুস্থ সন্তান তুলে দিতে পেরে ডাক্তার হিসেবে খুব তৃপ্তি পেয়েছি।”
ডাক্তারবাবু জানিয়েছেন, এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত দাতার কাছ থেকে পাঁচটি বা ছ’টি ডিম নেওয়া হয়। তার পরে স্বামীর শুক্রাণু নিয়ে নিষিক্ত করে ওই পাঁচটি বা ছ’টি ডিম থেকে তিনটি বা চারটি ভ্রূণ তৈরি হয়। তার থেকে একটি বা দু’টি প্রতিস্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে একটিই প্রতিস্থাপন করা হয়। তিনি বলেন, “বিজ্ঞান দেখিয়ে দিয়েছে, বেশি বয়সে মেয়েদের ডিম্বাণু অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু জরায়ুর কর্মক্ষমতা বজায় থাকে। আমরা হরমোন চিকিৎসার মাধ্যমে জরায়ুর ভ্রূণ ধারণ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে পারি।”
সন্তানের মৃত্যু বহু পরিবারকেই ভেঙেচুরে দেয়। এই দম্পতি যে তারই মধ্যে নতুন স্বপ্ন দেখতে পেরেছেন, তা অনেককেই আশার আলো জোগাবে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। ২০১০-এ স্টিফেন কোর্টের আগুনে একমাত্র ছেলেকে হারান ইছাপুরের শৈলেন বারিক। শোক ভুলতে পরের বছর একটি সন্তান দত্তক নেন তাঁরা। শুক্লাদেবীর সন্তানলাভের কথা শুনে শৈলেনবাবু বলেন, “আমরাও সন্তানের কথা ভেবেছিলাম। কোনও ডাক্তারই আশার আলো দেখাতে পারেননি বলে পিছিয়ে যাই। এঁরা যে সাহস দেখাতে পেরেছেন, সে জন্য শুভেচ্ছা রইল।”
৫৯ আর ৬৮-র মা-বাবা! সেই সন্তান যখন স্কুলের গণ্ডি পেরোবে, তখন তো তাঁরা প্রায় অশীতিপর। কী ভাবে বড় করবেন মেয়েকে? জীবনের প্রয়োজনে মেয়ে কী ভাবে পাশে পাবে তাঁদের? বিকাশবন্ধুবাবু জানিয়েছেন, সঞ্চয়ের একটা অংশ এই চিকিৎসার পিছনে গিয়েছে। বাকিটা তাঁরা রেখে দিতে চান মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য। শুক্লাদেবীর কথায়, “ডাল-ভাত খেয়েও থাকতে পারি। মেয়ের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য সব করতে পারি।”
এক মেয়ে চলে গিয়েছিল ২৫ তারিখ। ১৪ মাস পরে ফের মেয়ে এসেছে কোলে। ওই ২৫ তারিখেই।