মানবিক হোক সরকারি হাসপাতাল, চিঠি মুখ্যমন্ত্রীকে

শুধু মূল্যবান সরঞ্জাম বা ঝাঁ-চকচকে হাসপাতাল ভবন নয়। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় কর্মীদের ‘মানবিক মুখ’কেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হোক। কারণ, এর অভাবই প্রতি পদে টের পাচ্ছেন রোগীরা। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে এই আবেদন জানালেন এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি এবং পরে মৃত এক মহিলার পরিজনেরা। ওই পরিবারের অভিযোগ, যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা রোগীর প্রতিও চরম উদাসীন থাকেন হাসপাতাল কর্মীদের একাংশ। তাঁরা নিজেরা এর ভুক্তভোগী। মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁরা লিখেছেন, “আপনি নিজে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেন। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই পরবর্তী স্তরে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায় না। তাই ব্যর্থ হয় সরকারের হাজারো উদ্যোগ।”

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৫৬
Share:

শুধু মূল্যবান সরঞ্জাম বা ঝাঁ-চকচকে হাসপাতাল ভবন নয়। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় কর্মীদের ‘মানবিক মুখ’কেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হোক। কারণ, এর অভাবই প্রতি পদে টের পাচ্ছেন রোগীরা। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে এই আবেদন জানালেন এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি এবং পরে মৃত এক মহিলার পরিজনেরা। ওই পরিবারের অভিযোগ, যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা রোগীর প্রতিও চরম উদাসীন থাকেন হাসপাতাল কর্মীদের একাংশ। তাঁরা নিজেরা এর ভুক্তভোগী। মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁরা লিখেছেন, “আপনি নিজে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেন। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই পরবর্তী স্তরে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায় না। তাই ব্যর্থ হয় সরকারের হাজারো উদ্যোগ।”

Advertisement

চিঠিটি নিয়ে আপাতত তোলপাড় চলছে স্বাস্থ্য ভবনে। এ নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, বাঙুর সংক্রান্ত এই অভিযোগ তাঁদের চোখ খুলে দিয়েছে। তাই যথাযথ তদন্তের পরেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বলেন, “সব শুনেছি। রোগীস্বার্থের সঙ্গে আপস করা হবে না। উচ্চপর্যায়ের আর একটি তদন্ত হবে। তার পরে এ বিষয়ে কথা বলব।” বিস্তারিত মন্তব্য করতে চাননি এম আর বাঙুরের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “পরবর্তী স্তরের তদন্ত চলছে। তাই এখনই কোনও মন্তব্য করব না। তবে রোগীদের স্বার্থই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে, এই আশ্বাস দিতে পারি।”

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, শুধু মানবিক মুখের অভাবের প্রসঙ্গ নয়, তাঁদের অস্বস্তিতে ফেলেছে চিঠির অন্য একটি অভিযোগও। সেটা কী? ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী নামে ওই রোগিণীর পরিজনেরা লিখিত অভিযোগ করেছেন, ৮০ শতাংশ দগ্ধ ওই মহিলার স্যালাইন চালানো নিয়ে কর্তব্যরত নার্সরা গোড়া থেকেই নানা টালবাহানা করছিলেন। ইন্দ্রাণীদেবী যখন যন্ত্রণায় ছটফট করছেন, তখনও কেউ ফিরে তাকাননি। এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে বাড়ির লোকদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন নার্সরা। সেবন্তী মুখোপাধ্যায় নামে হাসপাতালের এক সহকারী সুপার তখন বিষয়টি জেনে ঘটনাস্থলে হাজির হন। তিনি নার্সদের ওই আচরণের প্রতিবাদ করলে উল্টে তাঁর বিরুদ্ধেই জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন ওই নার্সরা। ফলে নানা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় ওই সহকারী সুপারকে। মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিতে ইন্দ্রাণীদেবীর পরিজনেরা লিখেছেন, এমন চলতে থাকলে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় মানুষ আস্থা তো হারাবেনই, পাশাপাশি অন্য কেউ প্রতিবাদ করার সাহসও দেখাবেন না। এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে কড়া পদক্ষেপ করার অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁরা।

Advertisement

ওই পরিবারের অভিযোগ, বাঙুরের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাওয়ার পরেই ইন্দ্রাণীদেবীকে স্যালাইন দেওয়ার নির্দেশ দেন ডাক্তাররা। নানা টালবাহানার পরে স্যালাইন চালু হয়। কিছুক্ষণ পরে স্যালাইনের বোতল শেষ হয়ে আসছে দেখে বিষয়টি ওয়ার্ডের কর্তব্যরত নার্সকে জানান পরিবারের লোকেরা। অভিযোগ, নার্সরা সে কথায় কান দেননি। পরিবর্তে বাড়ির লোককেই স্যালাইন বন্ধ করে দিতে বলেন। আশপাশের অন্য শয্যার রোগিণীদেরও একই ভোগান্তি চলছিল বলে অভিযোগ। নিজেদের রোগিণীর স্যালাইন, অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা পরিবারের লোকদেরই করতে নির্দেশ দেন নার্সরা। অভিযোগ, ইন্দ্রাণীদেবীর পরিজনেরা এর প্রতিবাদ করলে দু’পক্ষে বচসা শুরু হয়। তখনই ঘটনাস্থলে আসেন ওই সহকারী সুপার। মুমূর্ষু রোগীর সঙ্গে এমন আচরণের তিনি প্রতিবাদ করলে তাঁর সঙ্গেও গোলমাল বাধে নার্সদের। বার্ন ইউনিটের মতো জায়গায়, যেখানে মুমূর্ষু রোগীদের ভিড়ই বেশি, সেখানে হাসপাতাল কর্মীদের এমন আচরণকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন ওই পরিবারের লোকেরা।

হাসপাতাল সূত্রে খবর, এমন ঘটনায় পরবর্তী সময়ে লজ্জিত হওয়ার পরিবর্তে নার্সরা জোট বেঁধে আন্দোলনের হুমকি দেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে উড়ো ফোনে হুমকিও আসে বলে অভিযোগ। সুপার সোমনাথবাবু স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে লিখিত ভাবে জানিয়েছেন, নার্সদের একাংশের এমন আচরণ শৃঙ্খলাহীনতারই নামান্তর। এটা প্রশ্রয় পেলে ভবিষ্যতে কড়া হাতে প্রতিষ্ঠান চালানো দুষ্কর হয়ে উঠবে। শুধু তা-ই নয়, কর্মীদের এমন আচরণের নজির যে কোনও প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে বলে তাঁর আশঙ্কা।

পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিও তাদের রিপোর্টে নার্সদের কতর্ব্যে গাফিলতির কথা জানিয়েছে। বিভিন্ন বিভাগের কর্মীদের মধ্যে যে কোনও সমন্বয় নেই, সে কথাও বলা হয়েছে। ওই রাতে যা ঘটেছিল, সামান্য মানবিক আচরণ করলেই যে তা এড়ানো সম্ভব হত, সেই অভিমতও জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

অভিযুক্ত নার্সরা অবশ্য জানিয়েছেন, সহকারী সুপারকে তাঁরা অপমান করেননি। উল্টে সহকারী সুপারের আচরণে তাঁরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। সেই কারণেই জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে তাঁরা অভিযোগ জানিয়েছেন। সুপরিকল্পিত ভাবে তাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলে তাঁরাও বিষয়টি মেনে নেবেন না বলে জানিয়েছেন ওই নার্সেরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement