মাথায় আঘাত নিয়ে শুক্রবার দুপুরে বারাসত হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে এসেছিলেন সত্তরোর্ধ্ব তুষার মহাপাত্র। পরিবারের অভিযোগ, রোগীর ন্যূনতম চিকিৎসাটুকুও না করে তাঁকে ওই হাসপাতাল থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। বলা হয়, “সব ডাক্তার আজ মিটিং-এ ব্যস্ত আছেন।” একই অভিযোগ প্রসূতি বিভাগে ভর্তি এক রোগিণীর আত্মীয়েরও। তাঁদের বক্তব্য, রোগিণীর অবস্থার অবনতি হচ্ছে দেখে তাঁরা ডাক্তারকে খবর পাঠাতে বলেছিলেন। কিন্তু ওয়ার্ড থেকে বলা হয়, “ডাক্তারবাবুরা ব্যস্ত আছেন। কাউকে পাওয়া যাবে না।’
কী এমন কাজে ব্যস্ত ছিলেন ডাক্তারবাবুরা? হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, সে দিন দুপুরে এক বেসরকারি হাসপাতালের তরফে ওই হাসপাতালের ডাক্তারদের জন্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তাই ওই ‘ব্যস্ততা’! তাই ইমার্জেন্সি, ইনডোরে রোগীদের ওই ভোগান্তি।
কাজের দিনে দুপুর দুটোয় ওই অনুষ্ঠানের অনুমতি দিলেন কে? হাসপাতালের তরফে কেউই এখন ‘অনুমতি’ দেওয়ার সেই দায় স্বীকার করতে চাইছেন না। সুপার অমিতাভ সাহা ছুটিতে রয়েছেন। তিনি কোনও কথা বলতে চাননি। আর কার্যনির্বাহী সুপার তপন রায়চৌধুরী বলেছেন, “এ সবের মধ্যে আবার আমাকে জড়ানো হচ্ছে কেন? আমি তো কিছুই জানতাম না!”
বারাসত হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তো বটেই, এমনকী ওই বেসরকারি হাসপাতালও অনুষ্ঠানের আয়োজনের নেপথ্যে উল্লেখ করেছে তৃণমূল সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠনের প্রতিনিধিদের নাম। ওই বেসরকারি হাসপাতালের মার্কেটিং বিভাগ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিল। মার্কেটিং অফিসার সপ্তর্ষি ঘোষের তরফে ডাক্তারদের এসএমএস করে ওই অনুষ্ঠানে হাজির থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। সপ্তর্ষিবাবু বলেন, “এ ব্যাপারে মূলত আগ্রহী ছিলেন হাসপাতালেরই কয়েক জন ডাক্তার। যা বলার, তাঁরাই বলতে পারবেন।” হাসপাতালের চিফ এগ্জিকিউটিভ (মেডিক্যাল) সুদীপ্ত মিত্রও যে ডাক্তারদের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁদের মধ্যে এক জন তৃণমূল সমর্থিত চিকিৎসক ইউনিয়নের সভাপতি, অন্য জন সম্পাদক।
সুদীপ্তবাবু বলেন, “ওঁরা আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। আমরা ওই কর্তৃপক্ষের কাছে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে লিখিত আবেদন করি। কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেন। আমাদের দু’জন ডাক্তার ওখানে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। আমরা নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে কিছু করিনি। এর পিছনে আমাদের কোনও স্বার্থও নেই। বরং ‘কন্টিনিউয়িং মেডিক্যাল এডুকেশন’ (সিএমই)-এর অংশ হিসেবে ডাক্তারদের স্বার্থেই এটা করা হয়েছে।”
যদিও বারাসত হাসপাতালের কর্মীদের একটা অংশের অভিযোগ, দিনের পর দিন ওখান থেকে বহু রোগীকে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে রেফার করেন ডাক্তারদের একাংশ। যে পরিষেবা বারাসত হাসপাতালে মিলতে পারে, সেটার জন্যই বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে রোগী পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলির কাছ থেকে সুবিধা আদায় করেন ওই ডাক্তাররা। শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের নামে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালকে আরও বেশি করে সরকারি চত্বরে ঢোকানোর পিছনে ওই ডাক্তারদেরই একাংশের মদত রয়েছে বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন তাঁরা।
বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূল সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন-এর রাজ্য সভাপতি নির্মল মাজি বলেন, “এটা খুবই লজ্জাজনক ঘটনা। আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত, ইতিমধ্যেই তাঁদের সতর্ক করা হয়েছে। কাজের দিনে সরকারি ডাক্তারদের ডেকে নিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল অনুষ্ঠান করবে, এটা বরদাস্ত করা যায় না।”
শুক্রবারের ওই অনুষ্ঠানকে ঘিরে স্থানীয় তৃণমূল চিকিৎসক সংগঠন খুবই তৎপর ছিল বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর। এক চিকিৎসকের অভিযোগ, “আমরা কয়েক জন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিইনি। রোগীদের সমস্যা হবে, বলেছিলাম। কিন্তু তৃণমূল ইউনিয়নের নেতারা আমাদের হুমকি দেন, এর ফল ভাল হবে না।”
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দফতর থেকে জানা গিয়েছে, ওই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনুমতি চাওয়া হলে তিনি হাসপাতালের নিজস্ব সেমিনার হলে অনুষ্ঠান করতে নিষেধ করেন। পরিবর্তে নার্সদের হস্টেলের সেমিনার হলে অনুষ্ঠান হয়েছে। ভরদুপুরে তাঁদের হস্টেলে যে ভাবে প্রচুর বহিরাগতের ভিড় হয়েছে, তা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন নার্সদের একাংশও।
তৃণমূল সমর্থিত চিকিৎসক ইউনিয়ন প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের স্থানীয় সভাপতি গোপেশ্বর মুখোপাধ্যায় বলেন, “এর আগেও দু’বার দু’টি বেসরকারি হাসপাতাল এখানে অনুষ্ঠান করেছে। তখন তো কোনও আপত্তি ওঠেনি। এ বার উঠছে কেন বুঝতে পারছি না। এর পিছনে কোনও বিশেষ গোষ্ঠীর অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।” ইউনিয়নের সম্পাদক রাজেশ শিকদার বলেছেন, “এখন এ ব্যাপারে কিছু বলা সম্ভব নয়।”
মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয় আচার্য ওই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন। তাঁর প্রশ্ন, “ওটা তো ডাক্তারদের জন্য একটা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ছিল। তাতে অসুবিধাটা কোথায়?” অসুবিধা যদি না-ই থাকে, তা হলে হাসপাতালের সেমিনার রুমে অনুষ্ঠান করতে বারণ করা হল কেন? এর কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। নার্সরা তাঁদের হস্টেলে নিরাপত্তার যে প্রশ্ন তুলেছেন, সে ব্যাপারেও নীরবই ছিলেন প্রলয়বাবু।