কেউ কিছু দেখেননি। কেউ কিছু শোনেননি। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে এক যুবকের খুনের ঘটনার পরে ওখানকার বাতাসে যেন ভাসছে অনুচ্চারিত সাবধানবাণী আপনারা কিন্তু কিছুই দেখেননি।
রবিবার ভোররাতের ওই কাণ্ডের পরে আবাসিকেরাও অতিমাত্রায় সতর্ক। প্রত্যেকে কথা বলছেন মেপে মেপে। জানাচ্ছেন, নিশুতি কাকভোরে ক’হাত দূরের ঘরে এক জনকে নৃশংস ভাবে পেটানো হলেও কোনও আর্তনাদ কারও কানে আসেনি। ফলে কেউ জানেন না, কারা ওকে পিটিয়ে মারল। সকলেরই দাবি, তাঁরা পরে ঘটনাটা জেনেছেন। শুনেছেন, চুরি করে পালাতে গিয়ে হাতে-নাতে ধরা পড়া একটি ছেলের মৃত্যু হয়েছে তাঁদেরই সতীর্থদের মারে।
ব্যস, ওই পর্যন্তই। কারা মারল, কখন মারল, কী ভাবে মারল সে সব সম্পর্কে ওঁরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে। অন্তত দাবি তেমনই। কিন্তু আবাসিক ছাড়াও কেউ কেউ তো রবিবার আনন্দবাজারকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা খুনের ঘটনাটা দেখেছেন! হস্টেল ভবনে কর্মরত এক নির্মাণ শ্রমিক জানিয়েছিলেন, সে রাতে কয়েক জনের সঙ্গে তিনি ওখানে ঘুমোচ্ছিলেন। চিৎকার-কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। “দেখি, বারো-চোদ্দো জন মিলে একটা ছেলেকে বেঁধে মারছে! আশপাশে আরও বেশ ক’জন জড়ো হয়েছে। শেষমেশ ছেলেটা যখন নেতিয়ে পড়ল, ভিড় পাতলা হয়ে গেল।’’ বলেছিলেন তিনি।
এ দিন ওঁরা কী বলছেন? পুলিশ বা হাসপাতালের তদন্ত কমিটি কি ওঁদের মতো প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান নিয়েছে?
ওই শ্রমিকের জবাব, “কেউ আমাদের কাছে কিছু জানতে চায়নি। উল্টে ছাত্র থেকে শুরু করে হাসপাতালের লোকজন, এমনকী পুলিশ সকলেই আমাদের শাসিয়ে যাচ্ছে। একটাই কথা বাইরের কারও কাছে যেন মুখ না খুলি!”
অর্থাৎ পাকে-প্রকারে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আপনারা কিছুই দেখেননি, কিছুই শোনেননি। সিনেমায় যেমন হয়। তফাত একটাই এখানে শাসানিদাতারা দাগি মাস্তান তো নয়ই, বরং সমাজের চোখে যথেষ্ট ইজ্জতদার! বস্তুত মাত্র ছত্রিশ ঘণ্টা আগে যেখানে ওই রকম মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড ঘটে গিয়েছে, নীলরতনের সেই বয়েজ হস্টেলের পরিবেশ সোমবার দিব্যি স্বাভাবিক। অন্তত উপরে-উপরে। নতুন বলতে বিল্ডিংয়ে ঢোকার মুখে দু’জন পুলিশকর্মীর উপস্থিতি। জানা গেল, এ দিন সকালে বেশ কিছু আবাসিক হস্টেল ছেড়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। একাধিক আবাসিক জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষ মৌখিক ভাবে তাঁদের অনুরোধ করেছেন বাড়ি চলে যেতে।
এ হেন অনুরোধ কেন?
এনআরএসের অধ্যক্ষা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, মাসখানেক বাদে পরীক্ষা। তাই অনেকে বাড়ি চলে যাচ্ছেন। “প্রতি বছরই এমন হয়। এর সঙ্গে রবিবারের খুনের ঘটনার কোনও যোগ নেই।” যুক্তি অধ্যক্ষার। হাসপাতালের একটি সূত্রে অবশ্য ইঙ্গিত মিলেছে, প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্রদের পুলিশ যাতে জেরা করতে না-পারে, সে জন্যই কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপ।
এ দিন কলেজের বিভিন্ন বর্ষে যথারীতি ক্লাস হয়েছে। কলেজ ক্যান্টিনেও আর পাঁচটা দিনের মতো পড়ুয়াদের জমাটি আড্ডা। হইচই। হস্টেলের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কারও বিশেষ মুখে উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। আপনাদের সতীর্থেরা এমন কাজ করতে পারেন?
প্রশ্নটা শুনে প্রথমে খানিকটা থতমত খেলেন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রটি। তার পরে উগরে দিলেন একরাশ ক্ষোভ “না পারার কারণ নেই। চোরের দৌরাত্ম্যে আমরা নাজেহাল। কর্তৃপক্ষ আমাদের কথায় কোনও দিন কান দেননি।” ওঁর অভিযোগ, হস্টেলে নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় আবাসিকেরা ফুঁসছিলেন। চরম একটা কিছু কখনও না কখনও ঘটতই। “তবে আমি ওই রাতে কাউকে দেখিনি।” শেষে এ কথাটা জুড়ে দিতে তিনিও ভোলেননি। হস্টেলে চুরির অভিযোগ কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য অস্বীকার করেননি। কলেজ কাউন্সিলের একাধিক সদস্য মেনে নিয়েছেন, নিরাপত্তার সমস্যা পুরনো। তা হলে সুরাহার ব্যবস্থা হয়নি কেন?
অধ্যক্ষা জানিয়েছেন, তার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকারি কাজে বিস্তর নিয়ম মেনে চলতে হয় বলে কিছুটা দেরি হচ্ছে। “পুলিশের সঙ্গেও কথা হয়েছে। সমস্যা ইতিমধ্যেই কিছুটা মিটেছে, বাকিটা দ্রুত মিটে যাবে।” আশ্বাস দিচ্ছেন অধ্যক্ষা। এনআরএস কর্তৃপক্ষের দাবি, রবিবারের ঘটনার পরে তাঁরা সমস্যার গোড়ায় পৌঁছতে চাইছেন। আর তাই এ দিন দুপুরে কলেজ হস্টেলে বেশ কিছু আলমারি পাঠানো হয়েছে। যাতে পড়ুয়াদের জিনিসপত্র সুরক্ষিত রাখা যায়।
‘চোর’ খুনের পরে চেতনা কিঞ্চিৎ বেড়েছে বলতে হবে!