স্ট্রোকের পরেও কিছুটা হাত-পা নাড়তে পারছিলেন তিনি। জড়ানো গলায় দু’চারটে শব্দও বলছিলেন। বাড়ির লোকেরা কাছের এক হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে গেলেন। তাঁদের আকুতি, যে ভাবেই হোক প্রাণে বাঁচান। হাসপাতালও সে দিকেই মনোযোগ দিল। এর ফলে পঞ্চাশোর্ধ সুবিমল রায় প্রাণে বাঁচলেন বটে, কিন্তু পঙ্গু হয়ে গেলেন।
চিকিৎসকদের মতে, সময়মতো রোগীর রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম অর্থাৎ পুনর্বাসনের চেষ্টা শুরু না করাতেই এই বিপর্যয়। আজ, বুধবার বিশ্ব স্ট্রোক দিবসে তাই আক্রান্তদের পুনর্বাসনের দিকটাতেই সব চেয়ে জোর দিতে চাইছেন তাঁরা। স্ট্রোক যদি ঠেকানো না-ও যায়, তা হলেও পরবর্তী সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নিয়ে রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর চেষ্টা গুরুত্ব পাক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র বার্তাও এটাই।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীতে এখন প্রতি ছ’জনের মধ্যে এক জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। ২০০০ সালের পর থেকে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা কিংবা ইউরোপের ধনী দেশগুলির চেয়ে উন্নতিশীল বা অনুন্নত দেশগুলিতেই স্ট্রোকের সংখ্যা বাড়ছে। খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস, ন্যূনতম শরীরচর্চাও না করা এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপকেই এর জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞেরা। তথ্য বলছে, পৃথিবীতে প্রতি বছর ৫৮ লক্ষ মানুষ স্ট্রোকে মারা যাচ্ছেন। এড্স, যক্ষ্মা এবং ম্যালেরিয়া মিলিয়ে পৃথিবীতে যত মানুষ মারা যান, স্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। প্রতি ৬ সেকেন্ডে এক জন মানুষ এর বলি হচ্ছেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে দ্বিতীয় এবং পঙ্গুত্বের কারণ হিসেবে চতুর্থ স্থানে রয়েছে এই অসুখ।
চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটক জানান, স্ট্রোক হওয়ার পরেও এক জনকে কী ভাবে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে সক্ষম করে তোলা যায়, সেটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এই কারণেই ‘ইন্টিগ্রেটেড স্ট্রোক রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম’কে এখন বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মস্তিষ্কের যে সব নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত, তার আশেপাশের কোষগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হয়। তিনি বলেন, “বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মস্তিষ্কের কোষগুলিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা সব চেয়ে জরুরি। পাশাপাশি, রোগীকে পছন্দের পরিবেশে রাখতে পারলে ভাল হয়। লোকজনের সঙ্গে মেলামেশারও দরকার। পছন্দের পরিবেশ বলতে আমরা বোঝাচ্ছি প্রিয় গান শোনানো, ভাল লাগা খাবার-দাবার দেওয়া ইত্যাদি। এ ভাবেই আগের জীবনে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয় রোগীর মধ্যেও।”
এই ব্যাপারে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, স্ট্রোক হওয়ার পরে স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছতে রোগীর ৭২ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। তার মধ্যেই পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়া উচিত। বাড়ির লোকের মনে রাখা উচিত, যত আগে এই প্রক্রিয়া শুরু করা যায়, রোগীর সুস্থ জীবনে ফেরার সম্ভাবনাও ততই বাড়বে।
স্নায়ু চিকিৎসক তৃষিত রায় জানান, রোগী যদি কোমায় থাকেন, তা হলেও সেই পর্যায় থেকেই প্যাসিভ ফিজিওথেরাপি শুরু করা দরকার। তাঁর কথায়, “অধিকাংশ মানুষেরই এখনও এই ব্যাপারে সচেতনতা কম। প্রশিক্ষিত ফিজিওথেরাপিস্টদের সাহায্য না নিয়ে অনেকেই হাতুড়েদের পাল্লায় পড়েন। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। প্রশিক্ষিত ফিজিওথেরাপিস্টদের কাছে শিখে নিয়ে বাড়ির লোককেও এ ব্যাপারে রোগীকে সাহায্য করতে হবে।”
চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ মনে করেন, গোড়ার দিকে কিছু দিন রোগীকে কোনও স্ট্রোক রিহ্যাব সেন্টারে রেখে চিকিৎসা করাতে পারলে ভাল হয়। কারণ ওই ধরনের কেন্দ্রগুলিতে যে পরিকাঠামো থাকে, বহু ক্ষেত্রেই বাড়িতে তার ব্যবস্থা করা কঠিন। আর্থিক কারণে বা অন্য কোনও অসুবিধায় যদি তেমন কোনও কেন্দ্রে ভর্তির ব্যবস্থা করা না যায়, সে ক্ষেত্রে দক্ষ ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে যাওয়া জরুরি। ফিজিওথেরাপিস্ট জয়ন্ত মুখোপাধ্যায় বলেন, “বহু ক্ষেত্রেই আইসিসিইউ থেকেই ফিজিওথেরাপি শুরু হয়ে যায়। আর তা জারি থাকে বাড়ি ফেরার পরেও। মনে রাখতে হবে, ফিজিওথেরাপিস্ট কিন্তু ২৪ ঘণ্টা রোগীর পাশে থাকবেন না। নার্স বা আয়ার দায়িত্বও অনেকটাই, পাশাপাশি বাড়ির লোককেও এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।”
কেবল সমবেদনা না জানিয়ে, রোগীর পাশে থেকে তাঁকে সক্ষম করে তোলার চেষ্টা করাই স্ট্রোক আক্রান্তের বড় দাওয়াই।