কথায় কথায় জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘট, রোগী মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাড়ির লোকজনের বিক্ষোভ, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের ফাঁকিবাজি, সিনিয়র ডাক্তারদের সময়ের আগেই হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতাএ সব যে কোনও সরকারি হাসপাতালেরই নিত্য দিনের ছবি। এমনকী বেসরকারি হাসপাতালগুলিকেও ইদানিং এর আওতার বাইরে রাখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে কী ভূমিকা হবে হাসপাতালের প্রশাসকের? সুপারের চেয়ারে যাঁরা বসেন, প্রশাসন সামলানোর অভিজ্ঞতা তাঁদের বিশেষ থাকে না। ফলে গোলমালও বাড়ে। তাই পরিস্থিতি সামলাতে এ বার স্বাস্থ্যকর্তাদের প্রশাসনিক জ্ঞান বাড়ানোর উপরে জোর দিচ্ছে রাজ্য সরকার।
হাসপাতাল প্রশাসন চালানোর প্রশিক্ষণ এ রাজ্যে আগেও ছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্রের আমলে কী ভাবে হাসপাতালগুলিকে এই প্রশিক্ষণের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা যায় সে নিয়ে একটি প্রস্তাব জমা পড়ে। তারই সূত্র ধরে কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে। তারা ক্লাসঘরে থিওরি পড়াচ্ছে, আর মেডিক্যাল কলেজগুলিতে পাঠিয়ে পড়ুয়াদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্তারা মানছেন, শুধু রেসিপি পড়ে যেমন রান্না শেখা যায় না, তার জন্য রান্নাঘরে ঢোকা প্রয়োজন, তেমনই হাসপাতাল সামলানোর জন্যও ক্লাসঘরে বসে তত্ত্ব পড়লে হবে না, হাসপাতালে হাতেকলমে অভিজ্ঞতা দরকার। শুধু স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় নয়, একাধিক কেন্দ্র চালু হয়েছে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেও। সর্বত্রই ক্লাসঘরের পাশাপাশি গুরুত্ব পাচ্ছে প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসও।
স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনে চালু হওয়া এমনই একটি কেন্দ্রের কর্ণধার, শল্য চিকিৎসক পূর্ণেন্দু রায় জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে এখনও পর্যন্ত তিনটি ব্যাচ পাশ করে বেরিয়ে গিয়েছে। তিনি জানান, এই পাঠ্যক্রম প্রথম তাঁরাই তৈরি করেন। তাঁর কথায়, “একজন দক্ষ এমবিএ যেমন বুঝবেন না, হাসপাতাল কী ভাবে চালানো যায়, তেমনই একজন ভাল ডাক্তারও সব সময় প্রশাসন চালানোর ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেন না। তার জন্য পৃথক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়। আমরা সেটাই দিচ্ছি।”
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও সম্প্রতি জানিয়েছিলেন, স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে যৌথ ভাবে তাঁরা এই ধরনের প্রশিক্ষণ শুরু করতে আগ্রহী। হাসপাতালের সুপার, সহকারী সুপারদেরই প্রথম দফায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে বলে জানান তিনি। পূর্ণেন্দুবাবুও জানান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দফতর যৌথ ভাবে কাজ করলে বিষয়টি আরও জোরালো হবে। তিনি বলেন, “বিভিন্ন হাসপাতালের সুপারদের যদি এই সব কেন্দ্রে ডেপুটেশনে পাঠানো হয়, তা হলে তাঁরা দৈনন্দিন হাসপাতাল পরিচালনার কাজটা ভাল সামলাতে পারবেন।”
সাধারণ ভাবে হাসপাতাল প্রশাসকের দু’বছরের এই কোর্সে ভর্তি হতে গেলে ন্যূনতম যোগ্যতা বিজ্ঞানের স্নাতক। কিন্তু ডাক্তাররা এই ধরনের কোর্স করলে তা আরও কার্যকরী হবে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দফতরের কর্তারা। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “হাসপাতালের কর্তার ‘বডি ল্যাঙ্গোয়েজ’টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনও একজন রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাসপাতালে যদি বিক্ষোভ হয়, তা হলে তা সামলানোর জন্য এমন একজনকে প্রয়োজন যিনি চিকিৎসাশাস্ত্রটা ভাল বুঝবেন, আবার বিক্ষোভ সামলানোর কৌশলগুলোও যাঁর জানা থাকবে। সে ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রশিক্ষণ আমাদের সুপার বা অধ্যক্ষদের খুব কাজে লাগতে পারে।”
একই বক্তব্য এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের। তাঁর কথায়, “ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে রোগীর পরিবারের বিক্ষোভ-সবটাই আমাদের সামলাতে হয়। প্রশাসন চালানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ যদি আমাদের সাহায্য করার জন্য থাকেন, তা হলে ভালই হয়। এখন সহকারী সুপার যাঁরা আছেন, তাঁরা হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু তাঁরা ডাক্তার নন। ডাক্তারদের এই প্রশিক্ষণ থাকলে তার প্রভাব ভাল হবে বলেই আমার ধারণা।”