স্পন্দন দাস।
তাঁর মৃত সন্তানকে ভেন্টিলেশনে রেখে টাকা আদায়ের চেষ্টা করেছে হাসপাতাল। পুত্রহারা বাবার অভিযোগ ছিল এটাই। স্থানীয় থানায় অভিযোগ জানিয়ে কোনও ফল হয়নি। স্বাস্থ্য ভবনও অভিযোগের চিঠি পেয়ে নিরুত্তরই ছিল। শেষ পর্যন্ত নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতরে চিঠি জমা দিয়ে এসেছিলেন পুত্রহারা বাবা। ওই চিঠিতেই ঘা পড়েছে অচলায়তনে। ন’বছরের শিশুটির মৃত্যুর ছ’মাস পরে ই এম বাইপাসের ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে স্বাস্থ্য দফতর।
গত সপ্তাহেই নবান্ন থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ পৌঁছেছে স্বাস্থ্য ভবনে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “আমরা নির্দেশ পেয়েছি। তদন্ত শুরু হয়েছে।” মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অকারণ বিল বাড়ানোর অভিযোগ ওঠে। যুক্তিহীন ভাবে বিভিন্ন ব্যয়বহুল পরীক্ষা এবং দামী ওষুধ-ইঞ্জেকশন দেওয়ার অভিযোগও উঠছে আকছার। পাশাপাশি যে অভিযোগ মাঝেমধ্যেই সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও আতঙ্ক বাড়িয়ে দেয় তা হল অকারণে এমন কী মৃত্যুর পরেও ভেন্টিলেশনে রেখে বিল বাড়ানোর চেষ্টা। সাধারণ রোগী তো বটেই, এমনকী চিত্র পরিচালক প্রয়াত অঞ্জন চৌধুরীর ক্ষেত্রেও এই একই অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁর পরিবারের লোকেরা।
স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্ব নেওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রকাশ্যেই একাধিক বার বলেছেন, তাঁর কাছে ‘খবর আছে’ যে বিভিন্ন হাসপাতাল মৃত মানুষকে ভেন্টিলেটরে রেখে টাকা আদায় করছে। এই প্রবণতা তাঁরা বরদাস্ত করবেন না বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি বদলেছে এমন দাবি কেউ করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে সরকারি তদন্তে বাইপাসের ওই হাসপাতালটির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ হোক বা না হোক, বহু হাসপাতালের কাছে এই তদন্তের নির্দেশ থেকেই একটা বার্তা যাবে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশ।
হাওড়ার উলুবেড়িয়ার বাসিন্দা প্রদীপকুমার দাসের ছেলে স্পন্দন দাস মার্চের শেষে হেপাটাইটিস এ-তে আক্রান্ত হয়ে বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিকু) ভর্তি ছিল। প্রদীপবাবুর অভিযোগ, ৩১ মার্চ সংশ্লিষ্ট চিকিত্সক তাঁকে জানিয়েছিলেন, তাঁর ছেলের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে এবং তাকে জেনারেল বেডে স্থানান্তরিত করার কথা ভাবা হয়েছে। কিন্তু সে রাতেই আচমকা তাঁকে জানানো হয় ছেলের অবস্থা খুবই সঙ্কটজনক এবং তাকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়েছে, এ জন্য খুব শীঘ্রই আরও কিছু টাকা জমা দিতে হবে।
প্রদীপবাবু লিখেছেন, সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কায় পরের দু’দিন তাঁকে বা পরিবারের কাউকেই পিকু-তে গিয়ে ছেলেকে দেখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তৃতীয় দিন তাঁরা ছেলের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বিশদে প্রশ্ন করতে শুরু করলে চিকিত্সকেরা যথেষ্ট বিরক্ত হন বলেও অভিযোগ। ৩ এপ্রিল রাতে পিকু-তে ঢুকে ছেলেকে দেখার অনুমতি পান তাঁরা। প্রদীপবাবু বলেন, “ছেলের গায়ে হাত রেখে দেখি বরফের মতো ঠান্ডা। যে ডাক্তার তখন ডিউটিতে ছিলেন তাঁকে প্রশ্ন করায় তিনি বললেন, গত দু’দিন এমন অবস্থায় রয়েছে ও। এর কিছুক্ষণ পরেই আমার ছেলেকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।”
এর পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চিকিত্সার দায়িত্বে থাকা তিন ডাক্তারের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করেন পরিবারের লোকেরা। অভিযোগ জানানো হয় স্বাস্থ্য ভবনেও। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তারা ঠারেঠোরে জানিয়ে দেন, বেসরকারি হাসপাতালকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনও ব্যবস্থাই কার্যত তাঁদের নেই।
কী বলছে ওই হাসপাতাল? চিকিত্সকেরা জানিয়েছেন, মৃত শিশুকে ভেন্টিলেশনে রাখার অভিযোগ ভিত্তিহীন। শিশুটি যথেষ্ট গুরুতর অবস্থায় ওই হাসপাতালে পৌঁছেছিল। সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো যায়নি। হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট সুদেষ্ণা লাহিড়ী বলেন, “আমি এপ্রিল মাসেই দায়িত্ব নিয়েছি। তাই এ নিয়ে বিশদে কিছু আমার জানা নেই।”
প্রদীপবাবু বলছেন, “আমার ছেলে যথাযথ চিকিত্সার পরেও বাঁচত কি না জানি না। কিন্তু সেই রাতে ছেলেকে যে অবস্থায় পিকু-তে দেখেছিলাম তাতে আমি নিঃসংশয় যে আগেই ওর মৃত্যু হয়েছিল। মৃত সন্তানকে নিয়ে মিথ্যাচার করার মানসিকতা কারও থাকে না। আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি, আর্থিক ভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছি। এই ব্যবসা যাতে বন্ধ হয়, এখন সেটাই আমার লড়াই।”