মায়ের সঙ্গে জয়। পাশে রুমালে সেই পেরেক। —নিজস্ব চিত্র
শতচ্ছিন্ন শাড়িতে এক মা এবং কোলে নেতিয়ে পড়া তাঁর একরত্তি ছেলে। সোমবার সকাল থেকে অজানা, অচেনা কলকাতা শহরের এসএসকেএম হাসপাতালের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন ওই মহিলা। দুধের শিশু খেলতে খেলতে একটা বড়সড় বাঁকা পেরেক খেয়ে ফেলেছিল। পেটের মধ্যে গত ছ’দিন ধরে আটকে ছিল সেই পেরেক। কোথায় গেলে কোন ডাক্তারবাবুকে পাওয়া যায়, কারা ওই শিশুটির জীবন বাঁচাতে পারেন, তার কোনও হদিসই তাঁর জানা ছিল না। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালেরই এক চিকিৎসক তাঁদের দেখে দয়াপরবশ হয়ে কী হয়েছে জানতে চান। তাঁরাই পাঠিয়ে দেন পিজি-র স্কুল অব ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড লিভার ডিজিজ-এ। সেখানকার চিকিৎসকরাই পেরেকটি বার করে সুস্থ জীবন দিয়েছেন শিশুটিকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পেটের মধ্যে এত দিন ধরে একটি বাঁকা পেরেক থেকে যাওয়ায় সংক্রমণের নানা আশঙ্কা তো ছিলই, পাশাপাশি সেটি বার করতে গেলে গলা এবং পেট দুই-ই চিরে যেতে পারত। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তেমন কিছুই ঘটেনি। বরং হাসি ফুটেছে মায়ের মুখে।
বীরভূমের দিমুড়িয়া গ্রামের ওই শিশু জয় বাগদী মঙ্গলবার সকালে বাড়ির উঠোনে খেলতে খেলতে একটা বড়সড় বাঁকানো পেরেক খেয়ে ফেলেছিল। বাবা দিনমজুর। মা মনসা বাগদীই সন্তানকে কোলে নিয়ে প্রথমে সিউড়ি সদর হাসপাতালে ছুটেছিলেন। সেখানে থেকে তাঁরা যান বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে। কোথাওই আশার আলো দেখা যায়নি। প্রতিবেশীদের কথায় ছেলেকে নিয়ে রবিবার কলকাতায় পৌঁছন মনসা। সল্টলেক ও বাইপাসের একের পর এক বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরেছেন। তাঁর কথায়, “সব জায়গাতেই বলল পেট কেটে পেরেক বার করতে হবে। ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ। তা-ও ছেলে বাঁচবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। আমাদের সব কিছু বেচে দিলেও ৫০ হাজার টাকা জুটবে না।”
সল্টলেকের এক হাসপাতালের কর্মীই তখন এসএসকেএমে শেষ চেষ্টা করে দেখতে বলেন। কিন্তু অত বড় হাসপাতালে কোথায় যাবেন, কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না মনসা। টানা কয়েক দিনের ধকলে হাসপাতাল চত্বরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময়েই এক চিকিৎসক তাঁদের স্কুল অব ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড লিভার ডিজিজ-এ পাঠান।
মঙ্গলবার সকালে হাসপাতালে ছেলেকে কোলে নিয়ে মনসা বলছিলেন, “ভেবেছিলাম আমার কোলটা খালি হয়ে গেল। কলকাতার ডাক্তারবাবুরাই সেটা আটকালেন। ওঁদের কাছে আমার ঋণের শেষ রইল না।”
কেন জেলার সরকারি হাসপাতালে শিশুটির পেট থেকে পেরেকটা বার করা গেল না? সিউড়ি সদর এবং বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তেমন পরিকাঠামো তাঁদের নেই। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলি জানিয়েছে, এন্ডোস্কোপি করে পেরেক বার করার ঝুঁকি খুব বেশি। তাই পেট কেটে বার করতে হত। সেই অস্ত্রোপচার এবং তার পরবর্তী খরচ কম করেও ৫০ হাজার টাকা।
বিভাগের প্রধান চিকিৎসক গোপালকৃষ্ণ ঢালি বলেন, “পাকস্থলীর গায়ে পেরেকটা আটকে ছিল। দক্ষ হাত ছাড়া অন্ত্র বা খাদ্যনালী ফুটো হয়ে যেতে পারত। কারণ পেরেকের মুখ তো ধারালো। বার করার সময়ে ফস্কে গিয়ে শ্বাসনালীতেও আটকে যেতে পারত। আমাদের চিকিৎসকদের গোটা দল শিশুটিকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিল। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা সফল। আমরা এন্ডোস্কোপি করেই পেরেকটি বার করেছি।”
বিভাগের চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর কথায়, “এই সব হতদরিদ্র মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতালে যথাযথ পরিকাঠামো থাকা কতটা জরুরি, তা আরও এক বার প্রমাণ হল। এঁদের পক্ষে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো অসম্ভব। সরকারি হাসপাতালে বিনা খরচে এই প্রক্রিয়াটি করা গিয়েছে বলে একটা বাচ্চা নতুন জীবন পেল।”