রাত বাড়লেই মদের আসর, বিভিন্ন ঘরে মাদকের আখড়া, মধ্যরাত পর্যন্ত গোলমাল— সবই চলছে অবাধে, সেই আগের মতো। কর্তৃপক্ষের কার্যত কোনও নজরদারিই নেই। এমনকী, হস্টেলের কোন ঘরে কে থাকেন, তার কোনও রোস্টারও অনুসরণ করা হয় না। ফলে কাগজে-কলমে পড়ুয়াদের আবাসন হলেও আদতে সেখানে সকলেরই অবারিত দ্বার!
বুধবার রাতে এবং বৃহস্পতিবার সকালে দু’দফায় এসএসকেএমের এমবিবিএস হস্টেলে ঢুকে বোঝা গিয়েছে, তিন মাস আগে ইন্টার্ন সপ্তর্ষি দাসের মৃত্যু থেকে কোনও শিক্ষাই নেয়নি এই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। বুধবারও গভীর রাত পর্যন্ত এসএসকেএমের এমবিবিএস হস্টেলের একাধিক ঘরে নরক-গুলজার চলেছে। শুধু আবাসিক নন, একাধিক বহিরাগতও হস্টেলের ভিতরে রাত্রিবাস করছেন বলে অভিযোগ। পড়ুয়াদের একাংশ জানান, এই ছবিই দেখা যায় প্রতিদিন। এ ব্যাপারে তাঁরা কর্তৃপক্ষকে সবই জানিয়েছেন। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ।
পরিস্থিতিতে রাশ টানতে হস্টেলেরই একটি ঘরে নতুন হস্টেল সুপারের থাকার বন্দোবস্ত করেছিলেন কর্তৃপক্ষ। তা ঘিরে ফের তেতে উঠেছে হাসপাতাল চত্বর। দফায় দফায় অধ্যক্ষকে ঘেরাও, বিক্ষোভ, হস্টেল কমিটির জরুরি বৈঠক সবই চলছে। কিন্তু হাসপাতাল কতার্দেরই একটা বড় অংশ মনে করছেন, মূল সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকছেন কর্তৃপক্ষ। ফের ‘অ্যাড-হক’ ভিত্তিতে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চলছে।
কেন? কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, সপ্তর্ষির মৃত্যুর পরে বিতর্ক ধামাচাপা দিতে তড়িঘড়ি যে হস্টেল সুপারকে দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছিল, তিনি এখনও সপরিবার তাঁর কোয়ার্টার্সেই থেকে গিয়েছেন। দায়িত্ব পাওয়া নতুন সুপারকে হস্টেলে দেখাই যায় না বলে অভিযোগ আবাসিকদের। আর সেই সুযোগেই অবাধে বসে নেশার আসর। কোনও নিরাপত্তারক্ষীর ব্যবস্থা নেই। এই পরিস্থিতিতে যে কোনও সময়ে ফের কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে আশঙ্কা পড়ুয়াদেরই একাংশের।
বৃহস্পতিবার সকালে হস্টেলে গিয়ে দেখা যায়, কোন আবাসিক কোন ঘরে থাকেন, তার কোনও রোস্টারেরই ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রায় সর্বত্রই সকলের অবাধ যাতায়াত। এই পরিস্থিতিতে কোনও স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা না করে ফের জোড়াতালি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা শুরু করেছেন কর্তৃপক্ষ। সেটা কী?
প্রাক্তন সুপার তাঁর কোয়ার্টার্স খালি করেননি বলে আবাসিকদের জন্য বরাদ্দ একটি ঘরেই নতুন হস্টেল সুপারের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সে নিয়ে আবাসিকদের একাংশ প্রতিবাদ শুরু করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, এর ফলে উৎখাত হতে হচ্ছে দু’জন ছাত্রকে। এ নিয়ে অধ্যক্ষের ঘরে গিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে ডিএসও-র ছাত্র ইউনিয়ন। বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল এবং ডিএসও-র ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে চাপান-উতোরও শুরু হয়েছে। এসএসকেএম তথা ‘ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র অবশ্য দাবি করেছেন, ঘরটি আসলে খালি পড়ে ছিল। তাই সাময়িক ভাবে সেটি ব্যবহার করবেন তাঁরা। স্থায়ী ব্যবস্থা কী হবে, তা অবশ্য জানাতে পারেননি তিনি। যেখানে হস্টেলে ঠাঁই পাওয়ার জন্য এত চেষ্টা চলে, সেখানে খালি ঘরই বা মিলছে কী ভাবে, কাটেনি সেই ধোঁয়াশাও।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে এসএসকেএমের এমবিবিএস হস্টেলে মৃত্যু হয় ইন্টার্ন সপ্তর্ষি দাসের। একাধিক ধরনের মাদক অত্যধিক পরিমাণে নেওয়ার ফলেই সপ্তর্ষির মৃত্যু হয় বলে গোয়েন্দারা জানান। এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ তখন জানিয়েছিলেন, এমন ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি কখনওই না হয়, তা নিশ্চিত করতে কিছু স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের কথা ভাবা হয়েছে। সেগুলি কী?
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, হস্টেলের জন্য স্থায়ী নিরাপত্তারক্ষীর কথা ভাবা হয়েছে। সেই রক্ষী একটি লগবুকে বাইরের কারা, কখন হস্টেলে ঢুকছেন তা নথিবদ্ধ করবেন। হস্টেলের আবাসিকদের রাতে ফেরার সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। ২৪ ঘণ্টার বেশি কোনও আবাসিক বাইরে থাকলে কর্তৃপক্ষকে তা আগাম জানাতে হবে। কাউকে না জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার বেশি বাইরে থাকলে সংশ্লিষ্ট আবাসিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া হস্টেলবাড়ির প্রত্যেক তলায় এক জন করে মনিটর রাখা হবে। সেই তলায় কোনও গণ্ডগোল হলে তৎক্ষণাৎ সেই মনিটরই হস্টেল সুপারকে তা জানাবেন।
বাস্তবে গত তিন মাসে যে এর কিছুই হয়নি, তা হস্টেলে সরেজমিন ঘুরে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। অধিকর্তা বলেন, “নেশাভাঙ যে পুরোদমে শুরু হয়েছে, সে খবর আমাদের কাছেও আছে। খুব কড়া নজরদারি ছাড়া এ সব ঠেকানো যাবে না। কিন্তু আমাদের অত লোকবল কোথায়?”
তা হলে তিন মাস আগে ওই সব প্রতিশ্রুতি তাঁরা দিয়েছিলেন কীসের ভিত্তিতে? উত্তর মেলেনি।