পাঁচের প্যাঁচ, মৃত শিশুকেও রাখা হচ্ছে ভেন্টিলেটরে

ডেঙ্গির পরে শিশুমৃত্যুর খতিয়ান। তথ্য গোপনের গুরুতর অভিযোগে ফের বিদ্ধ রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। আর এ ক্ষেত্রে উপরওয়ালাদের বিচিত্র নির্দেশের জেরে রাজ্যের শিশু চিকিৎসার অন্যতম সরকারি হাসপাতালটি যে পন্থা নিয়েছে, বলে অভিযোগ, তা-ও ততোধিক বিচিত্র। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, বিপজ্জনকও কম নয়। হাসপাতালটি হল কলকাতার বিসি রায় শিশু হাসপাতাল।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০২:১৬
Share:

ডেঙ্গির পরে শিশুমৃত্যুর খতিয়ান। তথ্য গোপনের গুরুতর অভিযোগে ফের বিদ্ধ রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। আর এ ক্ষেত্রে উপরওয়ালাদের বিচিত্র নির্দেশের জেরে রাজ্যের শিশু চিকিৎসার অন্যতম সরকারি হাসপাতালটি যে পন্থা নিয়েছে, বলে অভিযোগ, তা-ও ততোধিক বিচিত্র। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, বিপজ্জনকও কম নয়।

Advertisement

হাসপাতালটি হল কলকাতার বিসি রায় শিশু হাসপাতাল। সূত্রের খবর: পশ্চিমবঙ্গে শিশু রোগীদের জন্য একমাত্র এই রেফারেল হাসপাতালে উপরমহল থেকে ফরমান এসেছে, এক দিনে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা কোনও ভাবেই পাঁচের বেশি দেখানো যাবে না। অতএব, কোনও দিন মৃতের সংখ্যা পাঁচের ‘লক্ষণরেখা’ ছুঁয়ে ফেললেই আর কাউকে সে দিন মৃত ঘোষণা করা হচ্ছে না। বাড়তি কেউ মারা গেলেও নয়। হাসপাতালের ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে পাঁচের তালিকার বাইরে থাকা মৃত শিশুগুলিকে ভেন্টিলেটরে রেখে দিয়ে পর দিন তাদের মৃত ঘোষণা করা হচ্ছে। সে দিনও যদি দেখা যায় মৃতের সংখ্যা পাঁচ ছড়িয়ে যাচ্ছে, তা হলে পরে মারা যাওয়া শিশুদের ফের রেখে দেওয়া হচ্ছে ভেন্টিলেটরে, পরদিন মৃত ঘোষণায় অগ্রাধিকার দিয়ে।

এ ভাবে দিনের পর দিন ভেন্টিলেটর দখল করে রাখছে প্রাণহীন শিশু। শিশুমৃত্যুর সংখ্যা বেঁধে রাখার এ হেন মৌখিক নির্দেশে চিকিৎসকদের বড় অংশ স্তম্ভিত। খাস বিসি রায়ের কিছু ডাক্তারও স্বাস্থ্যভবনে প্রতিবাদ পেশ করে জানিয়েছেন, এটা চলতে থাকলে তাঁদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। “সেপ্টেম্বরে অন্তত চার দিন এমন ঘটেছে। এক দিনে পাঁচের বেশি রোগী মারা যাওয়ায় দু’টি বা তিনটি মৃত শিশুকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছিল। অক্টোবরেও দু’দিনের কথা আমি জানি।”— বলছেন বিসি রায়ের এক চিকিৎসক।

Advertisement

নিয়ম অনুযায়ী, কোনও হাসপাতালে এক দিনে পাঁচের বেশি শিশু মারা যাওয়াটা অস্বাভাবিক। তখন স্বাস্থ্যভবনকে জানাতে হয়। বিসি রায়ে ভর্তি শিশুদের অধিকাংশই সঙ্কটজনক অবস্থায় থাকে, এবং তাদের ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়। জটিল রোগীর ভিড় বেশি থাকায় এখানে মৃত্যুর হারও তুলনায় বেশি। যা কমিয়ে দেখাতে স্বাস্থ্য প্রশাসনের একাংশ মরিয়া উঠেছে বলে অভিযোগ। “উদ্দেশ্য, রাজ্যে শিশুমৃত্যু রোধে সরকারের সাফল্যের ঢাক পেটানো।” — আক্ষেপ করছেন এক চিকিৎসক।

সাম্প্রতিক কালে ডেঙ্গির দাপট সম্পর্কেও তথ্য গোপনের জন্য আঙুল উঠেছে স্বাস্থ্য দফতরের দিকে। অভিযোগ: ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যাতে কমিয়ে দেখানো হয়, বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের উপরে সে ব্যাপারে সরকারি তরফে পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। ঝামেলা এড়াতে বহু হাসপাতাল ডেঙ্গির রোগী ভর্তি করতে চায়নি। ডেঙ্গির রক্ত পরীক্ষাতেও অনীহা দেখিয়েছে অনেক ল্যাব। এতে ডেঙ্গি-আক্রান্তেরা আরও বিপদে পড়েছেন। একই ভাবে শিশুমৃত্যুর খতিয়ান বেঁধে রাখার নির্দেশও বিপদের সঙ্কেত বয়ে আনছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। কী ভাবে?

বিসি রায়ের একাধিক চিকিৎসকের দাবি: এমনিতেই ভেন্টিলেটর অপ্রতুল। ভেন্টিলেটর আটকে মৃত শিশুদের রেখে দেওয়ায় বহু মরণাপন্ন শিশু উপযুক্ত চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উপরন্তু থাকছে মারাত্মক সংক্রমণের আশঙ্কা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত নিওনেটোলজিস্ট অরুণ সিংহের কথায়, “মৃত শিশুকে ভেন্টিলেটরে রেখে দিলে মৃতের শরীরে জন্মানো ব্যাক্টেরিয়া ভেন্টিলেটরে চলে আসতে পারে। তাতে পরবর্তী যে শিশু ওই ভেন্টিলেটরে ঢুকবে, তার আক্রান্ত হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা।”

মৃতদের ভেন্টিলেটরে রাখার নির্দেশ দিলেন কে?

বিসি রায়-সূত্রের খবর, শিশুমৃত্যু প্রতিরোধের লক্ষ্যে রাজ্য সরকার যে টাস্ক ফোর্স গড়েছে, তার চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ই নির্দেশটি দিয়েছেন। ওঁর ফরমান, মৃত্যুর পরেও অন্তত পাঁচ থেকে ছ’ঘণ্টা শিশুকে ভেন্টিলেটরে রাখতে হবে। ত্রিদিববাবু নিজেও তা স্বীকার করেছেন। “আমাদের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক প্রোটোকল মেনেই। এতে রিস্যাসিটেশনের মাধ্যমে শিশুকে বাঁচানোর চেষ্টা হয়।”— যুক্তি দিয়েছেন তিনি। পাল্টা প্রশ্নও তুলেছেন, “এখানে তো নিখরচায় ভেন্টিলেটরে রাখা হচ্ছে! তা হলে সমস্যা কোথায়?”

মৃতদেহের ব্যাক্টেরিয়া ভেন্টিলেটরে ঢুকে পরবর্তী শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক হতে পারে না কি?

টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যানের আশ্বাস, “একটি শিশুকে বার করার পর ভেন্টিলেটর ভাল ভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয়। তাই সে ভয় নেই।”

ঘটনা হল, ত্রিদিববাবু ‘আন্তর্জাতিক বিধি’র যুক্তি দিলেও বিশিষ্ট শিশু চিকিৎসকদের একাংশ তা মানছেন না। যেমন অরুণবাবুর মন্তব্য, “শিশুকে মৃত্যুর পরেও ছ’ঘণ্টা ভেন্টিলেটরে রাখতে হবে, এমন কোনও আন্তর্জাতিক প্রোটোকল নেই। বরং সরকারি হাসপাতালের অতি প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর এ ভাবে অহেতুক আটকে রাখা অভাবনীয়।” ক্রিটিক্যাল কেয়ার চিকিৎসক শুশ্রুত বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “এমন প্রোটোকলের কথা আমার জানা নেই। শিশু হোক বা প্রাপ্তবয়স্ক, ভেন্টিলেশনে থাকাকালীন মারা গেলেই তাকে ভেন্টিলেটর থেকে বার করে নেওয়াটাই নিয়ম। তার পরে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে মৃতদেহ পরিজনকে দেওয়ার আগে চার ঘণ্টা অপেক্ষার পালা। কিছু ক্ষেত্রে মির্যাক্লের আশায় এক-আধ ঘণ্টা ভেন্টিলেটর চালু রাখা হয় বটে, তবে সে ঘটনা খুবই কম।” পেডিয়্যাট্রিক সার্জন বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “মৃত্যুর পরে তখনই ভেন্টিলেশনে রাখা হবে, যখন মৃতের কোনও অঙ্গ দান করার পরিকল্পনা রয়েছে। কারণ, ভেন্টিলেটর চললে দেহে কৃত্রিম ভাবে রক্ত সঞ্চালন হয়, তাতে অনেক অঙ্গ সচল থাকে। অঙ্গদানের ব্যধ্যবাধকতা না-থাকলে মৃতদেহ ভেন্টিলেশনে রাখার কথা ভাবাই যায় না!”

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কী মত?

বিসি রায়ের অধ্যক্ষা মালা ভট্টাচার্য বলেন, “ভেন্টিলেশনে শিশুর মৃত্যু হলে আমরা আপাতত তাকে আরও চার-ছ’ঘণ্টা সেখানে পর্যবেক্ষণে রাখছি। শিশুরা অনেক সময় অদ্ভুত ভাবে বেঁচে উঠতে পারে। কর্মজীবনের গোড়ায় আমার এমন একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল।” পাশাপাশি মালাদেবীর দাবি, “যদি দেখা যায় ভেন্টিলেটর খালি না-থাকায় কোনও গুরুতর অসুস্থ শিশু বঞ্চিত হচ্ছে, তা হলে নিশ্চয়ই ভেন্টিলেটর আটকে রাখব না!”

হাসপাতালের চিকিৎসকদের অনেকে কিন্তু জানিয়েছেন, এ রকম কোনও একটি ক্ষেত্রেও শিশুর ফের বেঁচে ওঠার নজির তাঁদের কাছে নেই। উপরন্তু এতে সঙ্কটজনক শিশু-রোগী ভেন্টিলেটরের সুযোগ হারাচ্ছে। “এই পদক্ষেপ কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”— বলছেন তাঁরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement