জীবনদায়ী ওষুধ কিনতে এসে আকছার ফেরত যাচ্ছেন রোগী বা তাঁদের পরিজনেরা। মিলছে না হার্টের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও। অথচ সেই দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে ‘যৌবন ধরে রাখার ওষুধ’, মস্তিষ্ককে ‘চাঙ্গা করা’র ওষুধ। শুধু তা-ই নয়, রয়েছে কেন্দ্রের নিষিদ্ধ করা একাধিক ওষুধও। এসএসকেএম থেকে প্রকাশ করা সেখানকার ন্যায্য মূল্যের দোকানের প্রায় ১৭০০ ওষুধের তালিকা (ওই তালিকা আনন্দবাজারের হাতে রয়েছে) নিয়ে এ বার সরব হয়েছেন সরকারি চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, তালিকার বহু ওষুধই অবৈজ্ঞানিক এবং অকার্যকর কম্বিনেশন-এর। ওষুধ ব্যবসাকে ঘিরে একটি বড়সড় চক্র এর পিছনে সক্রিয় বলে তাঁদের আশঙ্কা।
রাজ্যের সেরা সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএম-এর ওই ন্যায্য মূল্যের দোকানের ক্যাটালগ থেকে বিভিন্ন ওষুধের নাম ও নম্বর উল্লেখ করে অভিযোগ তুলেছেন ওই চিকিৎসকেরা। তাঁদের বক্তব্য, অন্য ন্যায্য মূল্যের দোকানেও এই একই ধরনের ‘অনিয়ম’ চলছে বলে খবর আসছে। ধাপে ধাপে তাঁরা সেগুলিও ধরবেন।
পিজি-র এই অনিয়মের তথ্য পৌঁছেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও। তিনি এ সম্পর্কে সবিস্তার রিপোর্ট চেয়েছেন বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর। স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান নিয়ে কোনও স্তরে কোনও দুর্নীতি যাতে না হয় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকলকেই সতর্ক করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
ফার্মাকোলজির শিক্ষক স্বপন জানা বলেন, “একটা উদাহরণ দিই। সাইপ্রোহেপটাডিন ওষুধটি এখন অ্যালার্জির ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু ওই দোকানে ওষুধটিকে গ্যাস্ট্রো ইনটেস্টিনাল অ্যান্ড হেপাটো বিলিয়ারি সিস্টেম-এর ওষুধের তালিকায় রাখা হয়েছে, যা কেন্দ্র কয়েক বছর আগেই নিষিদ্ধ করেছে। কী ভাবে একটা নিষিদ্ধ ওষুধ মেডিক্যাল কলেজের দোকানে থাকতে পারে, তা ভেবেই বিস্মিত হয়ে যাচ্ছি। ভিটামিন বি১, বি৬ এবং বি১২-এর মিশ্রণও নিষিদ্ধ। ওখানে সেই ভিটামিন মিশ্রণও পাওয়া যাচ্ছে।”
অথচ পিজিতে ওষুধের বিষয়ে নজরদারির জন্য ফার্মাকো ভিজিল্যান্স কমিটি আছে। ওষুধের তালিকা প্রকাশের আগে সেই কমিটির তা দেখে নেওয়ার কথা। প্রতি মাসে কমিটির একটি করে বৈঠকও বসে। তা হলে সেই কমিটির নজর এড়িয়ে এই ধরনের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে কী ভাবে? পিজির অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “এটা হওয়ার কথা নয়। ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান রাজ্যের একটা সফল প্রকল্প। এর গুরুত্ব কোনও ভাবেই ক্ষুণ্ণ হতে দেওয়া যায় না। অবিলম্বে খোঁজ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”
চিকিৎসকেরা প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক অযৌক্তিক মিশ্রণ নিয়েও। এক চিকিৎসকের কথায়, “আমরা ক্লাসে পড়ুয়াদের ওষুধের যথাযথ ব্যবহার এবং যুক্তিপূর্ণ প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজনীয়তার কথা শেখাই। বাজারের দোকানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। তা বলে মেডিক্যাল কলেজেও তা মানা হবে না? পড়ুয়াদের কাছে আমরা মুখ দেখাব কী করে? এটা দুর্ভাগ্যজনক।”
অভিযোগকারীদের বক্তব্য, ন্যায্য মূল্যের দোকানে পাওয়া যায় এমন বহু ওষুধের মিশ্রণ অবৈজ্ঞানিক ও অকার্যকর। কোনও চিকিৎসক আইনত তা লিখতে পারেন না। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁরা অন্য সরকারি হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের ক্যাটালগ সংগ্রহ করে সেগুলি খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা করবেন।
চিকিৎসকদের সংগঠন হেল্থ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন-এর সম্পাদক হীরালাল কোনার বলেন, “আমরাও এসএসকেএম কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিচ্ছি। আমাদের দাবি, অবিলম্বে ওই সব অবৈজ্ঞানিক ওষুধ দোকান থেকে তুলে নিতে হবে। যে সব ওষুধের কম্বিনেশন অবৈজ্ঞানিক এবং অকার্যকরী, সেগুলি রোগীদের দেওয়া তাদের ঠকানোরই সামিল। সরকার এমন প্রকল্পকে মদত দিয়ে যেতে পারে না।”
পিজির ন্যায্য মূল্যের দোকানের তরফে অম্বরীশ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য অভিযো নিয়ে স্পষ্ট ভাবে কিছু বলতে চাননি। তিনি বলেন, “অনেক বক্তব্য থাকতে পারে। সব কিছুর উত্তর এ ভাবে বলা সম্ভব নয়। কারও অভিযোগ থাকলে সরাসরি আমাদের সঙ্গে কথা বলুক।”