ধর্ষণের পরীক্ষায় মহিলা, শুধু ও-পার বাংলায় কেন

হাসপাতালের একটা ঘরে কার্যত হামলে পড়েছিলেন অনেকে। ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল এক নামী অ্যাথলিটের বিরুদ্ধে। তিনি নারী না পুরুষ, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হতে মেডিক্যাল পরীক্ষা চলছিল তখন। ওই পরীক্ষায় যাঁদের হাজির থাকা জরুরি, তাঁরা তো ছিলেনই। যাঁদের সেখানে কোনও ভূমিকাই নেই, তাঁদের মধ্যেও অনেকে ভিড় করেছিলেন সেই ঘরে।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৪ ০১:৪২
Share:

হাসপাতালের একটা ঘরে কার্যত হামলে পড়েছিলেন অনেকে।

Advertisement

ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল এক নামী অ্যাথলিটের বিরুদ্ধে। তিনি নারী না পুরুষ, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হতে মেডিক্যাল পরীক্ষা চলছিল তখন। ওই পরীক্ষায় যাঁদের হাজির থাকা জরুরি, তাঁরা তো ছিলেনই। যাঁদের সেখানে কোনও ভূমিকাই নেই, তাঁদের মধ্যেও অনেকে ভিড় করেছিলেন সেই ঘরে। তার পরে তাঁদের মধ্যেই কোনও এক জন মেডিক্যাল পরীক্ষার সেই ছবি মোবাইলে তুলে রাখেন। এমএমএসে তা ছড়িয়ে পড়ে হাতে হাতে। পরে এই নিয়ে অভিযোগ করেন ওই অ্যাথলিট।

এ-পার বাংলায় মেডিক্যাল পরীক্ষার নানা নৈতিক দিক নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন উঠেছিল সেই সময়ে। প্রশ্ন আবার উঠল। এ বারের প্রশ্ন ও-পার বাংলার হাইকোটের রায়কে ঘিরে। ধর্ষিতার পরীক্ষায় পুরুষ ডাক্তার নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ হাইকোর্ট। বলা হয়েছে, ধর্ষিতার শারীরিক পরীক্ষা করতে পারবেন মহিলা ডাক্তারেরাই। কারণ, পুরুষেরা পরীক্ষার দায়িত্বে থাকলে লাঞ্ছিতার মানসিক চাপ বেড়ে যায়।

Advertisement

প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ যদি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এখানে তা রূপায়ণ করা যাবে না কেন? বিশেষত এ দেশেও যখন সুপ্রিম কোর্ট মহিলা ডাক্তার দিয়েই ধর্ষিতার পরীক্ষা করানো বাঞ্ছনীয় বলে জানিয়েছে?

কিছু দিন আগেই ধর্ষণের পরীক্ষায় ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। যোনিমুখের পর্দা অটুট আছে কি না, তা পরীক্ষার জন্য ওই পদ্ধতি চালু ছিল। বিষয়টিকে মহিলাদের পক্ষে ‘অবমাননাকর’ বলে চিহ্নিত করে এবং সহবাস ছাড়াও নানা কারণে ওই পর্দা ছিন্ন হতে পারে বলে জানিয়ে তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ধর্ষণের পরীক্ষায় পুরুষ ডাক্তার নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার কী পদক্ষেপ করে, সেই বিষয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে।

ধর্ষিতার পরীক্ষায় কেন মহিলা ডাক্তারই দরকার, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন মনোবিদেরাও। তাঁরা বলছেন, ধর্ষণের পরে এক জন মহিলা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ভাবেও ভেঙে পড়েন। “বহু ক্ষেত্রেই পরীক্ষার নামে তাঁকে হাসপাতালেও নানান লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। মেয়েটির ‘ট্রমা’ বাড়তে থাকে। মহিলা ডাক্তার পরীক্ষা করলে সেই যন্ত্রণা কিছুটা কমে,” বলছেন মনোবিদ উপাসনা সরকার।

রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, মহিলা ডাক্তার পর্যাপ্ত সংখ্যায় নেই। তাই মহিলা ডাক্তার দিয়েই ধর্ষিতাকে পরীক্ষা করার নিয়ম মানা সম্ভব নয়। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে স্ত্রীরোগের মহিলা চিকিৎসক রয়েছেন। জেলায় অবস্থা শোচনীয়। মহিলা ডাক্তার নেই, এই বলে পরীক্ষা তো বন্ধ রাখা যায় না। পুরুষ ডাক্তাররাই পরীক্ষা করেন।”

বাংলাদেশ হাইকোর্ট দেশের স্বাস্থ্য দফতরকে এই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মহিলা চিকিৎসক, নার্স ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকর্তারা আদালতে জানান, তাঁরা ইতিমধ্যেই সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।

এ-পার বাংলায় এখনও পর্যন্ত এই নিয়ে আলাদা ভাবে কোনও ভাবনাচিন্তা শুরুই হয়নি। শুধু স্ত্রীরোগ চিকিৎসক নন, ফরেন্সিক মেডিসিনের চিকিৎসকেরাও ধর্ষিতার শারীরিক পরীক্ষা করতে পারেন। চিকিৎসক মহলের বড় অংশই ভাবছেন, সদিচ্ছা থাকলে মহিলা ডাক্তারদের দিয়ে ধর্ষিতাকে পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা চালু করতে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিনের এক শিক্ষক-চিকিৎসক বলেন, “বিষয়টি যদি জরুরি বলে মেনে নেওয়া হয়, সে-ক্ষেত্রে জেলার সব হাসপাতালেই অন্তত এক জন করে মহিলা স্ত্রীরোগ-চিকিৎসক রাখা দরকার। ও স্ত্রীরোগের মহিলা চিকিৎসকদের পোস্টিং সে-ভাবেই হওয়া উচিত। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিষয়টি মাথায় রাখা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেটা কেউ করেন না।”

এসএসকেএম হাসপাতালের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান বিশ্বনাথ কহালির বক্তব্য, ধর্ষিতার পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞের কোনও প্রয়োজন নেই। যে-কোনও মেডিক্যাল অফিসারই ওই পরীক্ষা করতে পারেন। তাঁর কথায়, “স্ত্রীরোগ বা ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগে মহিলা চিকিৎসক হয়তো কম। কিন্তু গোটা হাসপাতালে মহিলা মেডিক্যাল অফিসার নেই, এমন তো সচরাচর হয় না। যে-সব মহিলা মেডিক্যাল অফিসার থাকেন, তাঁদেরই এই পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া যায়। বড়জোর এর জন্য তাঁদের কিছু প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হতে পারে।”

নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরাও মনে করছেন, পরিকাঠামো যা আছে, তাতেই ধর্ষিতার প্রতি আরও সংবেদনশীল হওয়া সম্ভব। মানবাধিকার কর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলেন, “ধর্ষণের পরীক্ষা যে পুরোপুরি চিকিৎসক-নির্ভর নয়, এটা আগে বুঝতে হবে। আইনি বিষয়ের জন্য শারীরিক যে-পরীক্ষাটা জরুরি, তা যে-কোনও মহিলা ডাক্তার তো বটেই, এমনকী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সেরাও করতে পারেন। এই পরীক্ষার ‘স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল’ থাকে। প্রয়োজনীয় কিট যদি প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা হলেই যে-কোনও প্রশিক্ষিত মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী তা করতে পারবেন।”

রাজ্য মহিলা কমিশনও মনে করে, মহিলাদের এই ধরনের পরীক্ষায় আরও সংবেদনশীলতা প্রয়োজন। কমিশনের সদস্যেরা জানান, এ নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছেন তাঁরা। প্রয়োজন অনুভব করছেন সকলেই। সুপারিশও করা হচ্ছে বিভিন্ন তরফে। ও-পারের ঢেউ কবে লাগে এ-পারে, সেটাই দেখার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement