নিজের ভাঁড়ার উপুড় করেও কুলোচ্ছে না। অবসরের বয়স বাড়িয়ে, এমনকী অবসরপ্রাপ্তদের পুনর্নিয়োগের পরিকল্পনা করেও বিশেষ লাভ হয়নি। অগত্যা প্রস্তাবিত নতুন মেডিক্যাল কলেজগুলোয় শিক্ষক-চিকিৎসক জোগাতে বাইরের রাজ্যের মুখাপেক্ষী হওয়ার কথা ভাবছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালের অভিজ্ঞ ডাক্তারদেরও আনার চেষ্টা হতে পারে।
কার্শিয়াং, কোচবিহার, পুরুলিয়া, রায়গঞ্জ-সহ রাজ্যে আটটি নতুন মেডিক্যাল কলেজ তৈরির ঘোষণা আগেই হয়ে গিয়েছে। এর চারটে হবে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি মডেলে), চারটে কেন্দ্রীয় আর্থিক সহায়তায়। কেন্দ্রীয় সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গে আরও একটা মেডিক্যাল কলেজ গড়ার ছাড়পত্র সদ্য দিন কয়েক আগে দিল্লি থেকে স্বাস্থ্যভবনে এসে পৌঁছেছে। কেন্দ্রের শর্ত, সেটা হতে হবে দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। সেই মতো স্বাস্থ্য দফতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ডায়মন্ড হারবারে গড়ে তোলা হবে কেন্দ্রীয় সহায়তার পঞ্চম মেডিক্যাল কলেজটি।
অর্থাৎ, সব মিলিয়ে ন’টা নতুন কলেজ। প্রথম বর্ষেই মোট হাজারখানেক নতুন পড়ুয়া। কিন্তু তাদের পাঠ দেওয়ার মতো শিক্ষক-চিকিৎসক কী ভাবে মিলবে?
এ নিয়ে গোড়া থেকেই তুমুল বিভ্রান্তি। কারণ চালু কলেজগুলোতেই ধার করে শিক্ষক আনতে হচ্ছে। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় সহায়তার মেডিক্যাল কলেজ গড়তে মোট খরচের ৭৫% দিল্লি দেবে বটে, কিন্তু তার জমি ও লোকবলের পুরো সংস্থান রাজ্যকেই করতে হবে। স্বাস্থ্য-কর্তাদের বক্তব্য: অর্থ ও জমির জোগাড় করতে তেমন সমস্যা হবে না, যতটা হবে শিক্ষক পেতে। আপাতত যার সুরাহায় নিয়োগ-নীতি কিছুটা বদলানোর কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। কী রকম?
স্বাস্থ্য দফতর-সূত্রের খবর: শিক্ষক-চিকিৎসকের অভাব মেটাতে এর আগে অবসরের বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তাতে ঘাটতি বিশেষ মেটানো যায়নি। অবসরপ্রাপ্তদের ফের নিয়োগের পরিকল্পনাও কাজে আসেনি। এ বার তাই শিক্ষক-চিকিৎসক পদের জন্য রাজ্য সরকার দেশ জুড়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছে। সেই সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ দিন কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিৎসকদেরও মেডিক্যাল কলেজে নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে।
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ভিন রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকদের পশ্চিমবঙ্গে আসার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে আহ্বান জানানোর কথা ভাবা হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে দশ বছরের বেশি কাজ করছেন যে সব এমডি-এমএস ডাক্তার, তাঁদেরও আকৃষ্ট করার চেষ্টা হতে পারে।
কিন্তু ডাক্তারি পড়ুয়াদের শিক্ষাদানের সঙ্গে কোনও যোগ নেই, এমন সব ডাক্তারকে শিক্ষক-চিকিৎসকের পদে নিয়োগ করায় মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র সায় থাকবে তো?
স্বাস্থ্য দফতরের ইঙ্গিত, বেসরকারি হাসপাতালে ন্যূনতম দশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের যাতে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদে নিয়োগ করা যায়, এমসিআইয়ের কাছে তার অনুমোদন চাইবে রাজ্য। ওঁদের আশা, কাউন্সিল এতে আপত্তি করবে না। এ দিকে স্বাস্থ্য-সূত্রে জানা যাচ্ছে, বর্তমান নিয়ম মোতাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে অন্তত পাঁচ বছর চাকরি করলে তবেই অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করা যায়।
এমতাবস্থায় এমসিআই পশ্চিমবঙ্গের আবেদনে সাড়া দেবে কি না, সে সম্পর্কে সন্দিহান স্বাস্থ্যভবনের একাংশ। “শুধু একটা রাজ্যের জন্য নিয়োগ-বিধি এ ভাবে শিথিল করা কাউন্সিলের পক্ষে কতটা সম্ভব, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।” মন্তব্য এক কর্তার। বস্তুত পুরো উদ্যোগটি নিয়েই কিছু প্রশ্ন ইতিমধ্যে দানা বেঁধেছে দফতরের অন্দরে। স্বাস্থ্য-কর্তাদের কারও কারও মতে, এ ভাবে খানিকটা জোড়াতালি দিয়ে শিক্ষক আনতে শুরু করলে নতুন মেডিক্যাল কলেজগুলোয় পঠন-পাঠনের মান সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ থেকে যাবে। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কী ব্যাখ্যা?
সুশান্তবাবু অবশ্য আশঙ্কাটি সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিচ্ছেন। “নতুন মেডিক্যাল কলেজ খোলার প্রয়োজনীয়তা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না! কাজেই আমাদেরও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। তাই নতুন নিয়োগ-নীতির চিন্তা।” বলছেন তিনি।
দফতর সূত্রে খবর: মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ হল, নতুন মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলার কাছে যেন কোনও ঢিলেমি না-থাকে। প্রস্তাবিত নতুন কলেজগুলোর প্রতিটার ক্ষেত্রে কাজ শেষের লক্ষ্যমাত্রা (টার্গেট) বেঁধে দিতে বলেছেন তিনি। কবে কোনটা তৈরির কাজ শেষ হবে, তার চূড়ান্ত সময়সীমা ঘোষণা হবে লোকসভা নির্বাচনের পরে। এক-একটা কলেজ গড়ার দায়িত্ব থাকবে স্বাস্থ্য-কর্তাদের এক-এক জনের উপরে।
এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ না-হলে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য-কর্তাকে জবাবদিহিও করতে হতে পারে।