সংক্রমণ যেন শুধু রোগীর বাড়ির লোকজন থেকে ছড়ায়! যত বিধি-নিষেধ তাঁদের জন্য। হাসপাতালের কর্মী বা চিকিৎসকদেরও কি সতর্ক থাকার দায় নেই?
প্রশ্নটা প্রকট হচ্ছে শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে। সরকারি, বেসরকারি নির্বিশেষে। দক্ষিণ কলকাতার সেই নামী বেসরকারি হাসপাতালটির কথাই ধরা যাক। যেখানে রোগীকে একঝলক দেখতে হলে পরিজনকে জুতো খোলা-হাত ধোয়ার মতো নানা নিয়ম-কানুন মানতে হয়। সেটাই স্বাভাবিক। অথচ আইসিসিইউ বা সিসিইউয়ের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে ধরা পড়ে অনিয়মের ছবিটা। ডাক্তারবাবুরা বাইরের জুতো পরে গটগটিয়ে ঢুকে যাচ্ছেন! গায়ে একটা অ্যাপ্রন চাপানোরও দরকার মনে করছেন না! আবার বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে ওয়ার্ডের সামনে টানা ছ’ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে এক অনাবাসীর তো চক্ষু চড়কগাছ! একটি বারের জন্যও তিনি কাউকে মেঝে পরিষ্কার করতে দেখেননি। বরং দেখেছেন ডাক্তারবাবুদের বাইরের জুতো-জামা পরে অনবরত ওয়ার্ডে ঢুকতে-বেরোতে।
নামী-দামি হাসপাতালেও সতর্কতার এই হাল দেখে বহু রোগীর পরিজনেরা উদ্বিগ্ন। তাঁদের প্রশ্ন, নিয়ম মানার দায় কি শুধু তাঁদের একচেটিয়া? ডাক্তারদের জুতোয় ধুলো-নোংরা থাকে না? নাকি থাকলেও ডাক্তারের জুতো হওয়ার সুবাদে সব দোষ ধুয়ে যায়? হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষই বা কেন চোখ বুজে থাকবেন?
উত্তর দিতে গিয়ে চিকিৎসক মহল দ্বিধাবিভক্ত। ওঁদের বড় অংশের যুক্তি, বিদেশের হাসপাতালে জুতো খুলে ঢোকার নিয়ম উঠে গিয়েছে। যদিও বর্ষীয়ান চিকিৎসকদের অধিকাংশ ভিন্নমত। তাঁদের বক্তব্য: বিদেশে যে ভাবে পরিচ্ছন্নতা-বিধি মানা হয়, এখানে হয় না। চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, সঙ্কটজনক রোগীর ওয়ার্ডে ঢোকার আগে হাত ধোয়াটা সবচেয়ে জরুরি। রোগীর আত্মীয়ের কথা বাদ রইল, ডাক্তার-নার্সরাও বহু ক্ষেত্রে তা মানেন না। আর জুতো? সুকুমারবাবুর জবাব, “তিন-চার ঘণ্টা অন্তর মেঝে মোছা হলে হয়তো জুতো পরে ঢোকা চলত। কিন্তু সে তো এখানে প্রায় কোথাও হয় না!” এমনকী স্টেথোস্কোপ থেকেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে জানিয়ে ওঁর হুঁশিয়ারি, এক জন রোগীকে পরীক্ষা করে সেই স্টেথোয় অন্যকে পরীক্ষা করা উচিত নয়।
ডাক্তারবাবুরা কি এ সব মানছেন? চিকিৎসকের স্বীকারোক্তি, “না। সকলে মানেন না।” তা হলে উপায়?
সুকুমারবাবুর দাওয়াই, হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকে কড়া হতে হবে। “ওঁরা ডাক্তার-নার্সদের বাধ্য করুন নিয়ম মানতে।” বলছেন তিনি। নিজের ও সতীর্থদের সমালোচনা করে ক্যানসার-চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “রোগীর পরিজন আর ডাক্তারদের জন্য সতর্কতার বিধি আলাদা হতে পারে না। আমরা ডাক্তারেরা হামেশা বাইরের জুতো পরে ভিতরে ঢুকি। এটা বাঞ্ছনীয় নয়।” চিকিৎসক সুব্রত মৈত্রের কথায়, “বিদেশে আইটিইউয়ে জুতো পরে ঢোকা যায় ঠিকই। তবে সেই মাত্রার পরিচ্ছন্নতা এখানে বিরল। তাই বিদেশের ব্যবস্থা এখানে কতটা গ্রহণীয়, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।”
বস্তুত হাসপাতালের ওয়ার্ডে সংক্রমণ (চিকিৎসা পরিভাষায়, হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন) এখন সারা বিশ্বে মস্ত সমস্যা। একটানা আইসিইউ বা আইটিইউয়ে থাকলে এর শিকার হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। জ্যোতি বসুর মতো ভিভিআইপি হোন, বা সাধারণ রোগী এ সংক্রমণ কাউকে রেয়াত করে না। বার্ন ইউনিট, নার্সারি ও লেবার রুমেও এর জেরে মৃত্যু বাড়ছে। অথচ প্রতিরোধের চিত্রটি এই রাজ্যে বিবর্ণ।
কী রকম? স্বাস্থ্য-কর্তারা জানান, পশ্চিমবঙ্গে ‘ইনফেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’ চালু রয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক-নীতিও বলবৎ। “ওটি, লেবার রুম ইত্যাদি জায়গা থেকে সোয়াব নিয়ে ব্যাক্টেরিয়ার চরিত্র জানার চেষ্টা সব সময়ে চলে। কোন সংক্রমণে কী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে, তা ঠিক করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।” জানান স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা। আক্ষেপও করছেন, “বহু ডাক্তার গাইডলাইন না-মেনে মর্জিমতো অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন। এতে অনেকের শরীরে ওষুধের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে।”
এমতাবস্থায় ডাক্তার, নার্স, রোগীর পরিজন সকলেরই পরিচ্ছন্নতা-বিধি মেনে চলা জরুরি বলে কর্তাটির মত। আরজিকরের ক্রিটিক্যাল কেয়ার চিকিৎসক সুগত দাশগুপ্ত জানান, ওয়ার্ডে ঢোকার সময়ে সাধারণ সতর্কতা বলতে হাত ধোয়া, গ্লাভস-গাউন-মাস্ক পরা এবং ‘কাফ এটিকেট।’ অর্থাৎ, সর্দি-হাঁচি-কাশি থাকলে মাস্ক আবশ্যিক। “আন্তর্জাতিক গাইডলাইনে অবশ্য জুতোর সঙ্গে সংক্রমণের বিশেষ যোগ নেই। কয়েক ঘণ্টা অন্তর ওয়ার্ড ঠিকঠাক মোছা হলে জুতোয় সমস্যা নেই,” দাবি সুগতবাবুর। সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার প্রধান সুশ্রুত বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী এখন জুতোর নিয়ম বদলেছি। এখানে দু’ঘণ্টা অন্তর মেঝে মোছা হয়।” মধ্য কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালের সিইও প্রদীপ টন্ডনেরও বক্তব্য, “মেঝে পরিষ্কার থাকলে জুতোয় সমস্যা নেই। আমাদের দু’-তিন ঘণ্টা অন্তর মেঝে মোছার ব্যবস্থা রয়েছে।”
চিকিৎসক বা হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের আশ্বাস ও দাবি শুনেও রোগীর পরিজনেরা ভরসা পাচ্ছেন না। ওঁদের অভিযোগ, পরিচ্ছন্নতা নিয়ে তেমন তৎপরতা কোথাও চোখে পড়ে না। বরং অধিকাংশ জায়গায় উদাসীনতাই প্রকট। যেমন, চিকিৎসা-বর্জ্যের পাশে ডাঁই করে রাখা থাকে রোগীর কাচা অ্যাপ্রন, চাদর। আইসিইউ-আইটিইউয়ের মধ্যে দিব্যি খাওয়া-দাওয়া সারেন চিকিৎসাকর্মীরা। ফুলহাতা শার্ট পরেই একের পর এক রোগীকে পরীক্ষা করে যান চিকিৎসক।
বলা যেতে পারে সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালের কথাও। নামজাদা ডাক্তার রাত এগারোটায় এসে আইসিসিইউ, সিসিইউ-আইটিইউয়ে ঝড়ের গতিতে রাউন্ড দিলেন, বাইরের জুতো পরে। শু্য কভার লাগানোর সময় নেই! আইসিসিইউয়ে এক রোগীর বুকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে, কড়া অ্যান্টিবায়োটিক চলছে। অন্য রোগীর আত্মীয় ডাক্তারবাবুকে শুধোলেন, এ ভাবে ওয়ার্ডে ঢোকাটা কি ঠিক? সংক্ষিপ্ত উত্তর, “সময় নষ্ট করাবেন না। তাড়া আছে। দেরি হলে আপনার পেশেন্টকে দেখতে পারব না।”
রোগীর প্রাণের চেয়ে ডাক্তারবাবুর সময়ের দাম বেশি কিনা, সে প্রশ্ন করার সাহস ভদ্রলোকের হয়নি।