কলেজ হস্টেলে পুলিশি প্রহরা।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হস্টেলে পিটিয়ে খুনের ঘটনার ছত্রিশ ঘণ্টা পার। এখনও এক জন আবাসিককেও সরকারি ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারল না পুলিশ। পুলিশ-কর্তাদের একাংশের অভিযোগ, কলেজ কর্তৃপক্ষ অনুমতি না-দেওয়াতেই তাঁরা এগোতে পারেননি। কর্তৃপক্ষের সবুজ সঙ্কেত ছাড়া কোনও ছাত্রকে জেরা করার পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জলঘোলা হলে কে দায় নেবে, এই প্রশ্নটিও আলোচিত হয়েছে। এবং শেষমেশ ঠিক হয়েছে, এ ক্ষেত্রে ‘কৌশলী’ পন্থাই অবলম্বন করবে পুলিশ।
কী সেই পথ? পুলিশ-সূত্রের খবর: এন্টালি থানা সোমবার এনআরএসের হস্টেল সুপারকে চিঠি লিখে আবাসিকদের নাম ও বাড়ির ঠিকানা জানতে চেয়েছে। বেশ কিছু আবাসিক ইতিমধ্যে বাড়ি চলে গিয়েছেন। “ঠিকানা পেলে সন্দেহভাজনদের বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে। তাতে দু’দিকই রক্ষা হবে।’’ মন্তব্য এক অফিসারের। যে নির্মাণকর্মীরা ওখানে কাজ করছেন, ঠিকাদার সংস্থার কাছ থেকে তাঁদের নাম-ঠিকানাও চাওয়া হয়েছে।
পুলিশকর্তারা অবশ্য প্রকাশ্যে এ হেন ‘কৌশলের’ অস্তিত্ব মানতে চাইছেন না। বরং আবাসিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে না-পারার কথা এন্টালি থানা জানালেও কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষের দাবি, ইতিমধ্যে কুড়ি জন আবাসিকের সঙ্গে পুলিশ কথা বলেছে। যদিও সেটা সরকারি ভাবে কিনা, তার সদুত্তর মেলেনি। পুলিশ-সূত্রের বক্তব্য, তদন্তভার লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে যায়নি। মামলা এখনও এন্টালি থানার হাতে। এ দিন ঘটনাস্থলে লালবাজারের হোমিসাইডের (খুনের তদন্তের বিশেষজ্ঞ শাখা) অফিসারেরা গিয়েছিলেন, তবে তা নিছক পর্যবেক্ষণের স্বার্থে। এমন খুনের তদন্তে গোয়েন্দা দফতর নেই কেন?
গোয়েন্দা-প্রধানের জবাব, “তদন্তভার হোমিসাইড নেবে কি না, তা দেখা হচ্ছে। অনেক সময়ে পরেও দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়।”
এ দিকে ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালানোর জন্য স্বাস্থ্য দফতর ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল উঠছে। তুলছে পুলিশেরই এক সূত্র, যার সমর্থন মিলছে প্রত্যক্ষদর্শী কারও কারও কথায়। ওঁদের বক্তব্য, বাইরের লোকের কাছে যাতে তাঁরা মুখ না খোলেন, সে জন্য নানা দিক থেকে শাসানি আসছে। বস্তুত খাস কলকাতার অন্যতম মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে এমন কাণ্ডের পরেও কর্তৃপক্ষের তরফে পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। রবিবার রাতে এক সহকারী সুপার নিতান্ত দায়সারা ভাবে পুলিশকে জানিয়েছিলেন, হস্টেলে অনেক মোবাইল ফোন চুরি হচ্ছে এবং হস্টেল চত্বরে এক অজ্ঞাতপরিচয়ের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে খুনের প্রমাণ এবং পুলিশের তরফে স্বতঃপ্রণোদিত খুনের মামলা রুজু হওয়ার পরে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা মিলছে না বলে আক্ষেপ করেছেন তদন্তকারীদের একাংশ।
ছাত্রদের জন্য হস্টেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নতুন আলমারি। সোমবার।
এনআরএস-কর্তৃপক্ষ অভিযোগ মানতে নারাজ। কলেজের অধ্যক্ষা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “পুলিশি তদন্তে বাধা সৃষ্টি করার প্রশ্নই ওঠে না।” কলেজ কেন শুধু ঘটনাটি পুলিশকে জানিয়ে দায় সারল আর কেনই বা অভিযোগ দায়ের হল না, তা জানতে চাওয়া হলে স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে’র প্রতিক্রিয়া, “একটা অপরাধমূলক ঘটনায় পুলিশ নিজে থেকে তদন্ত শুরু করেছে। কলেজের নিজস্ব কমিটি আলাদা তদন্ত করছে। এতে তো কোনও সমস্যা নেই।”
অধ্যক্ষারও তা-ই অভিমত। কিন্তু ঘটনা হল, বাড়িতে অপরাধ ঘটলে বাড়ির মালিককেই পুলিশের কাছে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে পুলিশে অভিযোগ দাখিলের দায় কলেজের উপরে বর্তায়। তবু কলেজ তা করেনি কেন, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কাছে তা জানতে চাওয়া হলে টেলিফোনে তিনি বলেন, “নীলরতনের অধ্যক্ষার নেতৃত্বে তদন্ত হচ্ছে। পুলিশ-প্রশাসনও আলাদা তদন্ত করছে। তদন্ত-রিপোর্ট অনুযায়ী নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এ দিন বিধানসভায় কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া নীলরতন প্রসঙ্গ তুলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করলে চন্দ্রিমাদেবী একই কথা বলেছেন। অন্য দিকে এই ঘটনায় সরকার তথা হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে বিরোধী শিবির থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দর সর্বত্র সংশয় দানা বেঁধেছে। প্রশ্ন উঠেছে, অতীতে আরজিকর বা ন্যাশনাল মেডিক্যালে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘট রুখতে সরকার সাসপেন্ড করার হুমকি দিতে সময় নেয়নি। তাতে তৎক্ষণাৎ কাজ হয়েছে। তা হলে এত বড় একটা ঘটনার পরে স্বাস্থ্য দফতর কেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এফআইআর দায়ের করল না?
এমতাবস্থায় নীলরতনের তৃণমূল নিয়ন্ত্রিত ছাত্র সংগঠনের তরফে কোনও চাপ আসছে কি না, সেই প্রশ্ন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। লালবাজারের এক কর্তারও পর্যবেক্ষণ, “হস্টেলের ভিতরে এত বড় ঘটনা ঘটল! অথচ কেউ দেখলেন না! এমনটা হতে পারে না। কোনও চাপের কারণেই তাঁরা মুখ খুলতে চাইছেন না।” স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “কোনও চাপ নেই, ইতস্তত করার প্রশ্ন নেই। হাসপাতাল তো পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছে! তদন্ত শেষ না-হওয়া পর্যন্ত কিছুই প্রমাণ হচ্ছে না।” ছাত্র ছাড়া বহিরাগত কারও পক্ষে কি হস্টেলের চারতলায় উঠে এ ভাবে কাউকে মারা সম্ভব? সুশান্তবাবুর জবাব, “অনেক কিছুই হতে পারে। কোনও উদ্দেশ্যে বাইরের কেউ এটা করতে পারেন। প্রমাণ ছাড়া তো কাউকে দোষী বলা যাবে না। কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।”
প্রসঙ্গত, কলেজ কর্তৃপক্ষের গড়া তদন্ত কমিটি ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনও তদন্তই করছে না! তাদের বিচার্য একটাই হস্টেলে বহিরাগত ঢুকল কী ভাবে? এটা কি মূল সমস্যা থেকে মুখ ফেরানো নয়?
অধ্যক্ষা মঞ্জুদেবীর সাফ জবাব, “একেবারেই না। পুলিশের কাজ পুলিশ করছে। আমরা আমাদের কাজ করব।”
কিন্তু পুলিশেরই একাংশের অভিযোগ, ‘নিজেদের কাজ’ হিসেবে আদতে জুনিয়র ডাক্তারদের আড়াল করারই চেষ্টা চালাচ্ছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ক্যান্টিনের দুই কর্মী-সহ চার জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু তথ্য মিললেও ঘটনাস্থলে উপস্থিত বা হস্টেলের চার তলার আবাসিকদের জিজ্ঞাসাবাদ না-করলে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। নিহতের যুবকের পরিচয়ও এ দিন রাত পর্যন্ত জানা যায়নি। ফলে পুলিশ বুঝতে পারছে না, ঠিক কীসের জন্য তিনি হস্টেলে ঢুুকেছিলেন। গোয়েন্দা-প্রধানের কথায়, “ঘটনাস্থলে রক্ত, বাঁশ-কাঠের টুকরো, নাইলনের দড়ি পাওয়া গিয়েছে।” ময়না-তদন্তের রিপোর্ট থেকে প্রাথমিক ভাবে পুলিশ জানতে পেরেছে, আঘাতজনিত কার সব মিলিয়ে এনআরএসে হস্টেল-হত্যার জট গভীর। এ দিন বিধানসভায় কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া বলেন, তিনি ডাক্তারি পড়েছেন। সভার অনেক সদস্যই ডাক্তার। তাঁরাও হস্টেলে থাকতেন। ক্যাম্পাসে কখনও-সখনও ছোটখাটো মারামারি হলেও হস্টেলের ভিতরে এমন খুনের কথা তাঁরা কেউ ভাবতে পারতেন না। “অদূর ভবিষ্যতে যাঁদের কাছে মানুষ যাবে প্রাণ বাঁচাতে, তাঁরাই কেউ কেউ এক বহিরাগতকে পিটিয়ে খুন করে দিলেন! আমি প্রস্তাব করছি, এই সব হবু ডাক্তারের সাইকো-অ্যানালিসিস (মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা) করে দেখা হোক।” বলেন মানসবাবু।
ছবি: রণজিৎ নন্দী