পাভলভ

ছারপোকার বিষ ছড়ানো ঘরে রোগীকে বন্ধ করে শাস্তি

ছারপোকা মারা ওষুধের বিষ-গন্ধে ভরে গিয়েছে গোটা ঘর। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। সেই বন্ধ ঘরে জানলার গ্রিল আঁকড়ে চিৎকার করছেন এক যুবক। তিনি বাঁচতে চান। ছারপোকা মারার ওষুধ ছড়ানো ঘরে তাঁকে বন্ধ করে রেখে গিয়েছেন হাসপাতালের কর্মীরা। কারণ, সে দিন ওই মানসিক রোগী নাকি একটু বেশিই ‘উত্তেজিত’।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৪
Share:

ছারপোকা মারা ওষুধের বিষ-গন্ধে ভরে গিয়েছে গোটা ঘর। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। সেই বন্ধ ঘরে জানলার গ্রিল আঁকড়ে চিৎকার করছেন এক যুবক। তিনি বাঁচতে চান। ছারপোকা মারার ওষুধ ছড়ানো ঘরে তাঁকে বন্ধ করে রেখে গিয়েছেন হাসপাতালের কর্মীরা। কারণ, সে দিন ওই মানসিক রোগী নাকি একটু বেশিই ‘উত্তেজিত’। তাই অন্যদের সঙ্গে নয়, ওষুধ ছড়ানো বদ্ধ ঘরে তাঁকে একাই থাকতে হবে, তাতে তাঁর মরণ-বাঁচন যা-ই হোক। পাভলভ মানসিক হাসপাতালের ঘটনা।

Advertisement

ছারপোকা মারার ওষুধ স্প্রে করা হয়েছিল শুক্রবার। তাই তিনতলার মেল ওয়ার্ড থেকে সমস্ত রোগীকে নামিয়ে আনা হয় দোতলায়। শুধু নামানো হয়নি ১৮ বছরের মনোরোগী অশোক দাঁকে। একে ওই গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছিল, তার উপরে ঘরে একা থাকার আতঙ্কে চিৎকার, কান্নাকাটি শুরু করে দেন ওই তরুণ। কোনও সাড়া না মেলায় জানলার গ্রিল ধরে ঝাঁকাতে শুরু করেন তিনি। ঘণ্টা কয়েক এমন চলার পরে গ্রিলের একটা অংশ ভেঙে যায়। সেই ফাঁকা অংশ গলে বেরিয়ে পাইপ বেয়ে তিনতলা থেকে একতলায় নেমে আসেন অশোক। তাঁকে দেখে শোরগোল পড়ে যায়। আর তার পরেই চটজলদি শাস্তির বিধানও হয়ে যায়। কী সেই শাস্তি?

অশোককে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা আটকে রেখে দেওয়া হয় খাঁচার মতো ছোট্ট একচিলতে ঘরে। চারপাশে জাল লাগানো সেই ঘরে কার্যত সূর্যের আলোও ঢোকে না। প্রথম দিকে তাঁকে খেতেও দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। পরে হাসপাতাল কর্মীদেরই একটা অংশ এ নিয়ে সোচ্চার হওয়ায় খাবার জুটেছিল, কিন্তু মুক্তি মেলেনি। বিষয়টি নিয়ে আনন্দবাজারের তরফে খোঁজখবর শুরু হওয়ায় শনিবার বিকেলে মুক্তি পান অশোক। এই ঘটনা স্তম্ভিত করে দিয়েছে মনোরোগ চিকিৎসকদের। তাঁদের বক্তব্য, এক জন মনোরোগীর অস্থিরতা কমাতে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা কোনও সভ্য দেশে হয় না। এই ঘটনাকে ‘ববর্রোচিত’ বলছেন তাঁরা। হাসপাতালেরই এক চিকিৎসকের কথায়, “মানসিক রোগীদের অধিকার নিয়ে গালভরা আলোচনা হচ্ছে ইদানীং। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে যে পশুরও অধম আচরণ করা হয়, এই ঘটনা আরও এক বার তা প্রমাণ করল।”

Advertisement

চিকিৎসকেরা বেশ কয়েকটি দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ওই স্প্রে করার পরে ঘরে কাউকে রাখা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এমনকী, তা প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয়ত, ১৮ বছরের তরুণ কোনও সরঞ্জাম ছাড়াই গ্রিল ভেঙে ফেললেন, তার অর্থ গ্রিল শক্তপোক্ত না। তা ছাড়া পাইপ বেয়ে নীচে নামার সময়ে পড়ে গিয়েও তাঁর মৃত্যু হতে পারত।

দিন কয়েক আগেই পাভলভের ওয়ার্ডে ছারপোকার উপদ্রব নিয়ে খবর বেরোয়। পোকার কামড়ে রোগীরা রাতে এক সঙ্গে দুটো-তিনটে করে ঘুমের ওষুধ খাচ্ছেন। তাতেও ঘুমোতে পারেন না। তার পরেই স্বাস্থ্য ভবন থেকে খোঁজখবর শুরু হওয়ায় অবশেষে একটি সংস্থাকে ছারপোকা মারার দায়িত্ব দেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ছারপোকা মারতে গিয়েও যে এক রোগীর এমন প্রাণান্তকর পরিস্থিতি হবে, তা কেউ ভাবতে পারেননি। পাভলভে রোগীদের এমন দুর্দশা অবশ্য এই প্রথম নয়। বছর কয়েক আগে রোগিণীদের বিনা পোশাকে রাখার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় তোলপাড় হয়েছিল গোটা রাজ্যে। নিয়মিত হাসপাতালের উপরে নজরদারির জন্য কমিটি গড়ারও নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু কার্যত তার কিছুই হয়নি।

অশোকের ঘটনা নিয়ে হাসপাতালের সুপার সুবোধরঞ্জন বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি মোবাইল ধরেননি। হাসপাতালের অন্য কর্তাদের সাফাই, অশোক অন্য রোগীদেরও বিরক্ত করছিলেন। তাই এই ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। মনোরোগ চিকিৎসক জ্যোতির্ময় সমাজদার বলেন, “কোনও রোগী উত্তেজিত হয়ে পড়লে তখন তাঁকে চোখের আড়াল করা ঠিক নয়। এটা খুবই বিপজ্জনক। বরং তখনই তাঁর বেশি যত্ন প্রয়োজন। তা না হলে যে কোনও বড় বিপদ ঘটতে পারে। তা ছাড়া, এখন এত ভাল ওষুধ বেরিয়েছে যে রোগী অস্থির হয়ে পড়লে ১৫ মিনিটের মধ্যে তাঁকে শান্ত করা সম্ভব।”

পাভলভের প্রাক্তন চিকিৎসক আশিস আচার্য বলেন, “শুধু তো একটা ছোট্ট ঘরে আলাদা করে রাখা-ই নয়। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে নগ্ন করে রাখা হয়, যা অত্যন্ত অমানবিক। ওই সব ঘরে একটা বাল্ব পর্যন্ত জ্বলে না। মশার কামড়ে রোগীরা অস্থির হয়। আমার সময়ে আমি বহু প্রতিবাদ করেছিলাম। তাতে উল্টে আমিই অপদস্থ হয়েছি।”

সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, “বিদেশে তো বটেই, এ দেশের অন্যান্য রাজ্যেও যখন রোগীকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘সলিটারি সেল’-এ রাখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ সেই ট্র্যাডিশন আঁকড়ে রয়েছে। যাঁরা পাভলভ পরিচালনা করেন, তাঁদের এই জ্ঞানটাই নেই, এটা অত্যাচারের আওতায় পড়ে। এ জন্য কঠোর শাস্তিও হতে পারে।”

কিন্তু সেই শাস্তিটা দেবে কে? এ বারের ঘটনার পরে মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের উপ অধিকর্তা সুবীর কীর্তনিয়া বলেছেন, “পাভলভে কী হচ্ছে, আমার জানা নেই।” সব ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষকর্তাদের এই সব প্রশ্ন করলে তাঁরা হয় বলেন, “এমন কোনও খবরের কথা জানি না” বা বলেন, “খতিয়ে দেখব।”

স্বাস্থ্য ভবন থেকে খতিয়ে দেখার আগে পাভলভে আরও অঘটন ঘটে যায় কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশ। অনেকের মতে, মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা থাকা উচিত। এখন সেখানে নপরাজিত মুখোপাধ্যায় অপরাজিত ভাবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, তাঁর সেই দরজাটা বড়ই শক্ত। হাজার ধাক্কাতেও খোলে না। রবিবার তাঁর মোবাইলে ফোন করলে উত্তর আসে, “আমি ওঁর স্টাফ বলছি। উনি নেই।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement