চাপে পড়ে রোগীদের ‘জেলখানা’ তুলে দিল পাভলভ

রাজ্য জুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠায় বাধ্য হয়েই রাজ্যের মানসিক হাসপাতালগুলি থেকে ‘সলিটারি সেল’ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। হিংস্রতা বা অন্য কোনও অজুহাতে এ বার আর রাজ্যের কোনও মানসিক হাসপাতালে কোনও রোগীকে আলাদা ঘরে আটকে রাখা চলবে না। যদি কোথাও এমন ঘটে, তা হলে তৎক্ষণাৎ সেখানকার আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৪২
Share:

পাভলভে সেই সেলের ভাঙা দেওয়াল। —নিজস্ব চিত্র

রাজ্য জুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠায় বাধ্য হয়েই রাজ্যের মানসিক হাসপাতালগুলি থেকে ‘সলিটারি সেল’ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। হিংস্রতা বা অন্য কোনও অজুহাতে এ বার আর রাজ্যের কোনও মানসিক হাসপাতালে কোনও রোগীকে আলাদা ঘরে আটকে রাখা চলবে না। যদি কোথাও এমন ঘটে, তা হলে তৎক্ষণাৎ সেখানকার আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন।

Advertisement

প্রথম ধাপে কলকাতার পাভলভ হাসপাতালে এই সেল ভেঙে দেওয়া হল। এর পরে ধাপে ধাপে বহরমপুর ও পুরুলিয়া মানসিক হাসপাতালেও তা করা হবে। পাভলভে ওই সেল-এর জায়গায় সাধারণ ওয়ার্ড তৈরি হচ্ছে।

পাঁচ মাস আগে পাভলভে আঁখি নামে এক রোগিণীকে নগ্ন অবস্থায় নির্জন ঘরে আটকে রাখার খবর আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়। তার পরেই তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় গোটা রাজ্যে। ওই রোগিণীকে ভাঙা তারের জাল লাগানো অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। দিনে দু’বার শুধু জালের ফাঁক দিয়ে খাবারটুকু পৌঁছে দেওয়া হত। একা, অন্ধকার ঘরে ওই ভাবে আটকে থেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

Advertisement

এই ঘটনা সামনে আসায় চার দিক থেকে ধিক্কারের ঝড় ওঠে। মনোরোগ চিকিৎসকেরা একবাক্যে জানান, মানসিক রোগীদের এ ভাবে আটকে রাখলে তার ফল আরও মারাত্মক হতে পারে। আধুনিক যে সব ওষুধ বেরিয়েছে, তাতে কোনও রোগীকেই শান্ত করার জন্য এ ভাবে রাখার প্রয়োজন পড়ে না বলেও জানিয়ে দেন তাঁরা। সমালোচনার মুখে তড়িঘড়ি তদন্ত কমিটি গড়ে স্বাস্থ্য দফতর। সাসপেন্ড করা হয় পাভলভের সুপার-সহ তিন কর্তাকে। হস্তক্ষেপ করে মানবাধিকার কমিশন ও রাজ্য মহিলা কমিশনও। সকলের মিলিত চাপে আঁখি নামে ওই রোগিণীকে ভাঙাচোরা, নির্জন সেল থেকে বাইরে আনা হয়।

মানবাধিকার কর্মীরা তখনই প্রশ্ন তুলেছিলেন, আঁখির ক্ষেত্রে না হয় চাপে পড়ে মুক্তির ব্যবস্থা করল স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে কী হবে? এমনিতেই মানসিক হাসপাতালগুলির উপরে সরকারের নজরদারি তলানিতে। তাই পোশাকের অভাব, আধপেটা খাওয়া থেকে শুরু করে সারা গায়ে উকুন পর্যন্ত অনেক কিছুই সহ্য করতে হয় রোগীদের। এ সবের প্রতিবাদ করলে ফের যে কোনও হাসপাতালে কোনও রোগীকে নির্জন ঘরে আটকে রাখা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? স্বাস্থ্যকর্তারা তখনই জানিয়েছিলেন, এর স্থায়ী প্রতিকারের কথা ভাবা হচ্ছে। সেই পথ ধরেই এ দিন পাভলভ মানসিক হাসপাতালের সলিটারি সেল-টি ভেঙে দেওয়া হয়।

রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে বলেন, “মানসিক হাসপাতালগুলির হাল ফেরাতে আমরা বদ্ধপরিকর। হাসপাতালগুলির নানা অব্যবস্থা সামনে এসেছে। ধাপে ধাপে সব কিছুরই পরিবর্তন হবে।”

শুধু আঁখি নামে ওই রোগিণী নন, মাস কয়েক আগে অশোক নামে এক বন্দিকেও পাভলভে এ ভাবে আটকে রাখা হয়েছিল। তাঁর ক্ষেত্রে অবস্থাটা ছিল আরও করুণ। কারণ যে ঘরে ছারপোকা মারা ওষুধ স্প্রে করা হয়েছিল, তাঁকে রাখা হয়েছিল সেই ঘরেই। ঘরে বন্দি হয়ে অতিষ্ঠ অবস্থায় তিনি জানলার গরাদ ভেঙে পালানোর চেষ্টা করে গুরুতর আহত হন।

বিদেশে তো বটেই, এ দেশের কিছু রাজ্যেও যখন রোগীকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘সলিটারি সেল’-এ রাখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ সেই ট্র্যাডিশন আঁকড়ে ছিল। এ বার তা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা এক সংগঠনের তরফে রত্নাবলী রায় বলেন, “এটা খুব বড় একটা পদক্ষেপ। এ নিয়ে আমরা প্রচুর তদ্বির করেছিলাম। কিন্তু শুধু একটা হাসপাতালেই যেন তা সীমাবদ্ধ না থাকে, সেটা রাজ্য সরকারকে দেখতে হবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement