অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায়। সাঁইথিয়া গ্রামীণ হাসপাতালে। ছবি: অনির্বাণ সেন
অপারেশন থিয়েটারের সামনে দু’পাশে সারি দিয়ে বসে মহিলারা। সংখ্যাটা অন্তত একশো। প্রত্যেকের কপালে নম্বর লেখা ছোট্ট স্ট্রিকার সাঁটা।
সেই নম্বর ধরে অপারেশন থিয়েটারে তাঁদের ডাকা হচ্ছে। ভিতরে দু’জন চিকিৎসক লাইগেশন অর্থাৎ বন্ধ্যাকরণ করাচ্ছেন। অস্ত্রোপচারের পরে স্ট্রেচারে করে পাঁজাকোলা করে স্ট্রিকার সাঁটা মহিলাদের একটি লম্বা বারান্দার মেঝেতে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘণ্টাখানেক পরে সেই হলঘরে গিয়ে দেখা গেল সারি সারি অচেতন মহিলা শুয়ে রয়েছেন। কিন্তু মাথার উপরে পাখা নেই। গরমে তাঁরা দরদর করে ঘামছেন। দেওয়ালে ঝুলছে ঝুল। কিছুটা দূরে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে তাঁদের আত্মীয়-পরিজনেরা।
শনিবার বীরভূমের সাঁইথিয়া গ্রামীণ হাসপাতালে গিয়ে এই দৃশ্যই দেখা গিয়েছে। দিনের শেষে ব্লক মেডিক্যাল অফিসার কবিতা শাসমল বলেন, “এত মহিলা এলে ক’জনকে ফেরাব? এ দিন ১১৫ জনের বন্ধ্যাকরণ করা হয়েছে। সবাই সুস্থ রয়েছেন। তা ছাড়া এখান থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে যাচ্ছি। তাই কাউকে ফেরাতে পারিনি।” তিনি জানান, এ দিন তাঁর সঙ্গে ছিলেন সিউড়ি ১ ব্লকের বড়চাতুরি বিপিএইচসি-র চিকিৎসক রতন শাসমল।
তবে একদিনে ১১৫ জনের বন্ধ্যাকরণ করা হয়েছে শুনে চোখ কপালে তুলেছেন জেলা প্রশাসনের অনেকেই। এক স্বাস্থ্য কর্তার কথায়, “একজন চিকিৎসক একসঙ্গে ২৫ জনের বেশি বন্ধ্যাকরণ করাতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে দু’জন চিকিৎসক বড়জোর ৫০ জনের করতে পারতেন।” জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর প্রতিক্রিয়া, “এক দিনে এত লাইগেশন! কিছু হয়ে গেলে কী হবে? আমি দেখছি।” জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীও বলেন, “এমনটা হওয়ার কথা নয়। স্বাস্থ্য দফতের সঙ্গে কথা বলছি।” তবে শুধু এ দিনই যে বিরাট সংখ্যক মহিলার বন্ধ্যাকরণ করা হয়েছে, তা নয়। স্বাস্থ্যকর্মীরা জানাচ্ছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই এখানে প্রচুর মহিলার বন্ধ্যাকরণ করানো হচ্ছে। বাসিন্দাদের দাবি, সপ্তাহে শুধু একদিন শনিবার এখানে বন্ধ্যকরণ হয়। সপ্তাহে দিনটা বাড়ালে সংখ্যাটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে।
শুধু সংখ্যা নিয়েই নয়, যে পরিবেশের মধ্যে অস্ত্রোপচারের পরে রাখা হচ্ছে, তা নিয়েও ক্ষুদ্ধ অনেকে। যেমন সাঁইথিয়ার হাতড়া গ্রামের চন্দনা দাস পুত্রবধূ গীতার বন্ধ্যাকরণ করাতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, “অস্ত্রোপচারের পরে বারান্দার নোংরা মেঝেতে বৌমাকে ওরা শুইয়ে দিল। এই দুর্বল শরীরে যদি কোনও রোগ-ব্যাধি বাঁধে, তার দায় কে নেবে? এই গরমে পাখা চালানোরও ব্যবস্থা নেই। কী কষ্টটাই না ওরা পেল।” বন্ধ্যাকরণ করাতে আসা মহিলাদের সঙ্গে আসা কাগাস গ্রামের অনাদি বাগদি, ময়ূরেশ্বরের অমুয়া গ্রামের নেবি বাদ্যকরের ক্ষোভ, “আমরা গরিব বলে সরকারি হাসপাতালে এসেছি মনে করে এমন দুরাবস্থার শিকার হলাম। অর্ধচেতন মেয়েদের বারান্দা থেকে আমাদেরই পাঁজাকোলা করে গাড়িতে নিয়ে যেতে হল। একজন স্বাস্থ্যকর্মীও এগিয়ে এলেন না! কিছু বলতে গেলেই স্বাস্থ্যকর্মীরা মুখ ঝামটা দিচ্ছেন।”
বন্ধ্যকরণ করাতে এলাকায় এত আগ্রহ কেন? এলাকায় দাইমা বলে পরিচিত লক্ষ্মী হাজরা, মজুদা বিবি বলেন, “আমরা গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে মেয়ে-বউদের বন্ধ্যাকরণ করাতে নিয়ে আসি। বিনিময়ে তাঁরা কিছু টাকাও আমাদের দেন।” স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, আশা কর্মীরাও এলাকায় বন্ধ্যাকরণ করানোর প্রচার চালাচ্ছেন। তাতেও আগ্রহ বাড়ছে। তাই সাঁইথিয়ার মতো আরও কয়েকটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও বন্ধ্যাকরণ করাতে আসা মহিলাদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু পরিষেবা না বাড়িয়ে শুধু বন্ধ্যাকরণের সংখ্যা বাড়িয়ে স্বাস্থ্য দফতরের হয়তো বাহবা জুটতে পারে, কিন্তু একটা বিপর্যয় ঘটে গেলে তার পরিণাম কী হবে, সেটা কি জেলা স্বাস্থ্য-কর্তারা ভেবেছেন। প্রশ্ন ভুক্তভোগীদের। যদিও এর সদুত্তর মেলেনি। বীরভূমের জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কার্তিক মণ্ডলকে ফোন করা হলে তিনি মন্তব্য করবেন না জানিয়ে ফোন রেখে দেন।