বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ আকছার ওঠে। সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্য দফতরে অভিযোগ করলে স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়ে দেন, বেসরকারি হাসপাতালের উপরে তাঁদের কার্যত নিয়ন্ত্রণ নেই। এ বার খোদ এক স্বাস্থ্যকর্তা তাঁর মায়ের মৃত্যুর পরে শহরের এক নামী বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। হাসপাতালে অভিযোগ দায়েরের সঙ্গে নিজের দফতরের শীর্ষ কর্তাদের দ্বারস্থও হয়েছেন তিনি। চিঠি পৌঁছেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতরেও।
ওই কর্তার বক্তব্য, স্বাস্থ্য দফতরের উচ্চপদে থেকেও তিনি যদি এমন হয়রানির শিকার হন, তা হলে আমজনতার অবস্থা কতটা সঙ্গীন, তা সহজেই অনুমেয়। কুষ্ঠ বিভাগের যুগ্ম অধিকর্তা সুকুমার দাসের মা পারুল দাস (৭৮) দু’সপ্তাহ ভর্তি ছিলেন সল্টলেকের আমরি হাসপাতালে। সেখানে তাঁর মাথায় একটি টিউমার অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচারের পরে তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন বলে হাসপাতালের তরফে দাবি করা হলেও আচমকাই এক দিন ফোনে জানানো হয় পারুলদেবীর অবস্থার অবনতি হয়েছে। এর পরে দ্রুত তাঁর বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হতে শুরু করে। হাসপাতালের তরফে জানানো হয়, তাঁর সেপ্টিসেমিয়া হয়েছে। ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়। দু’দিন ভেন্টিলেশনে রাখার পরে ওই বৃদ্ধাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। ডেথ সার্টিফিকেটেও মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয় ‘পোস্ট অপারেটিভ সেপটিক শক’।
সুকুমারবাবুর অভিযোগ, চিকিৎসা চলাকালীন আগাগোড়া তাঁদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে। ওই হাসপাতালে ভর্তির আগে বাইপাসে আমরি গোষ্ঠীর ভিশন কেয়ার হাসপাতালে ছিলেন পারুলদেবী। সেখানে তাঁর কিছু পরীক্ষা হয়। সল্টলেক আমরি-তে চিকিৎসা শুরুর সময়ে সেখানকার সমস্ত রিপোর্ট দেওয়া হলেও তাঁরা কিছু না দেখেই চিকিৎসা শুরু করেন। সুকুমারবাবুর অভিযোগ, তাঁর মায়ের অবস্থার অবনতি শুরু হলে, কোনও চিকিৎসকই দায় নিতে চাননি। অস্ত্রোপচারকারী শল্যচিকিৎসক জানান, যা বলার আইটিইউ-এর চিকিৎসক বলবেন। আইটিইউ-এর ইনচার্জ আবার জানান, রোগীর অবস্থা শল্যচিকিৎসকই বেশি ভাল জানেন। সুকুমারবাবু বলেন, “পিংপং বলের মতো এক ডাক্তার থেকে অন্য ডাক্তারের কাছে ঘুরেছি। সদুত্তর মেলেনি। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে যেখানে চিকিৎসা করানো হচ্ছে, সেখানে রোগী কেমন আছেন সেই তথ্যটুকুও কেন পরিজনেদের জানার অধিকার থাকবে না? স্বাস্থ্য দফতরের উচ্চপদে থেকে আমারই যদি এমন অবস্থা হয়, তা হলে সাধারণ মানুষের কী অভিজ্ঞতা হয় ভেবে শিউরে উঠছি।”
কী বলছেন স্বাস্থ্যকর্তারা? দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর (প্রশাসন) হরেকৃষ্ণ চন্দ বলেন, “বিষয়টি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্বাস্থ্য দফতর এই সব হাসপাতালের লাইসেন্সিং অথরিটি। ত্রুটি হয়ে থাকলে সেটা বরদাস্ত করা হবে না।” কিন্তু এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার তেমন কোনও নজির রয়েছে কি? স্বাস্থ্যকর্তারা তেমন কিছু জানাতে পারেননি।
আমরি-র সিইও রূপক বড়ুয়ার দাবি, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। ক্রনিক সংক্রমণ থেকেই সেপ্টিসেমিয়া হয় ওই রোগিণীর। হাসপাতালের তরফে সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি।
প্রায় ছ’লক্ষ টাকা বিল হয়েছিল পারুলদেবীর। হাসপাতাল এক লক্ষ ছাড় দিয়েছে। পরেও যে অঙ্কটা বাকি থাকে, দেহ ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পরে এখনও তা পুরো মেটাননি সুকুমারবাবু। প্রশ্ন করা হয়েছিল, হাসপাতালের তরফে কোনও গাফিলতি না থাকলে এক লক্ষ টাকা ছাড় দেওয়া হল কেন? আমরি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, চিকিৎসক বা তাঁদের পরিবারের জন্য হাসপাতালে কিছুটা ছাড়ের ব্যবস্থা তাঁরা করেছেন।
২০১১-র ডিসেম্বরে আগুন লেগে ৯১ জন রোগীর মৃত্যুর ঘটনার পরে বন্ধ ছিল ঢাকুরিয়া আমরি। স্বাস্থ্য দফতরের ছাড়পত্র পাওয়ার পরে শনিবার ফের খুলতে চলেছে ওই হাসপাতাল। তার ঠিক আগেই স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে এমন বিতর্কে জড়িয়ে স্বভাবতই অস্বস্তিতে রয়েছেন হাসপাতালের কর্তারা।