গর্ভপাত এড়াতে গর্ভধারণের আগেই বাঁধন জরায়ুমুখে

পর পর তিন বার গর্ভপাত হয়েছিল দেবারতি লাহিড়ির। তৃতীয় বার তো বেশ খানিকটা পরিণত সময়ে। ডাক্তাররা বলেছিলেন, গর্ভপাতের কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ভবিষ্যতেও যে এমন ঘটবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। দেশের বিভিন্ন শহরে চিকিৎসা করিয়েও কোনও ফল পাননি তিনি। শেষ পর্যন্ত এই তরুণীকে মাতৃত্বের সুখ খুঁজে দিলেন কলকাতার চিকিৎসকরাই। আর সেটাও আপাত-সরল এক পদ্ধতিতে। কী রকম?

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৪ ০২:২১
Share:

পর পর তিন বার গর্ভপাত হয়েছিল দেবারতি লাহিড়ির। তৃতীয় বার তো বেশ খানিকটা পরিণত সময়ে। ডাক্তাররা বলেছিলেন, গর্ভপাতের কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ভবিষ্যতেও যে এমন ঘটবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। দেশের বিভিন্ন শহরে চিকিৎসা করিয়েও কোনও ফল পাননি তিনি। শেষ পর্যন্ত এই তরুণীকে মাতৃত্বের সুখ খুঁজে দিলেন কলকাতার চিকিৎসকরাই। আর সেটাও আপাত-সরল এক পদ্ধতিতে। কী রকম?

Advertisement

বটুয়ার মতো হাল্কা ফাঁস। আর তাতেই কেল্লা ফতে। একাধিক বার গর্ভপাতের জেরে সন্তানধারণ যাঁদের কাছে দুরাশায় পরিণত হয়েছে, তাঁদের জরায়ুর উপরের অংশ সেলাই করে গর্ভপাতের আশঙ্কাটাই অঙ্কুরে বিনাশ করা সম্ভব এমনটাই দাবি চিকিৎসকদের।

যে চিকিৎসক দেবারতির কোলে সন্তান এনে দিয়েছেন, সেই গৌতম খাস্তগির জানান, জরায়ু সেলাই করার পদ্ধতি আদতে বেশ পুরনো। দু’ধরনের সেলাই করা যায়, শিরোদকার স্টিচ এবং ম্যাকডোনাল্ড স্টিচ। দুই আবিষ্কর্তার নামে ওই সেলাই পদ্ধতিগুলি পরিচিত। কিন্তু ওই তরুণীর ক্ষেত্রে ওই ধরনের প্রচলিত সেলাইও কোনও কাজে আসেনি। ম্যাকডোনাল্ড স্টিচ দেওয়ার পরেও তাঁর গর্ভপাত হয়। শেষ বার তাই পদ্ধতিটা খানিকটা বদলে নিয়েছিলেন তিনি। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার আগেই সেলাই করা হয়েছিল জরায়ুমুখ।

Advertisement

কিন্তু জরায়ু যদি সেলাই করাই থাকবে, তা হলে কোনও মহিলা সন্তানের জন্ম দেবেন কী ভাবে? গৌতমবাবুর ব্যাখ্যা, “এই আলগা ফাঁস তো শক্ত গিঁট নয় যে খোলা যাবে না। বটুয়া যেমন দড়ি ধরে টানলে আটকে যায়, এ-ও তেমনই। জরায়ুমুখের চারদিকে ফাঁসের মতো সেলাই করা হয়। তা ছাড়া, দেবারতির তিন-তিন বার গর্ভপাত হয়েছিল। তাই চতুর্থ বার পুরোটাই ছিল পরিকল্পিত। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার আগেই পেট কেটে জরায়ুর উপর থেকে ফাঁসের মতো করে সেলাই করা হয়েছিল। চিকিৎসার পরিভাষায় এর নাম ‘অ্যাবডোমিনাল এনসার্কলেজ।’ এই সাবধানতা অবলম্বন করার পরে দেবারতি অন্তঃসত্ত্বা হন। তার পরে আর কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। নির্বিঘ্নেই একটি সুস্থ পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে পেরেছেন তিনি।”

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে ১০ জনের একাধিক বার গর্ভপাত হয়ে যায়। আর সেই ১০ জনের মধ্যে আবার পাঁচ জনের ‘সার্ভাইকাল ইনকমপিটেন্স’ থাকে। অর্থাৎ জরায়ুর মুখ এমনই ঢিলে থাকে যে জরায়ু ভ্রূণ ধরে রাখতে পারে না। একে বলে ‘সার্ভাইকাল ইনকমপিটেন্স’। সেই সব ক্ষেত্রে ‘অ্যাবডোমিনাল এনসার্কলেজ’ প্রক্রিয়া খুব কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে গর্ভধারণের পর নয়, তার আগেই সেলাইটা করে দেওয়া দরকার।

গৌতমবাবুর কথায়, “বার বার গর্ভপাত হওয়া মানেই সব আশা-ভরসা শেষ হয়ে যাওয়া নয়। পথ রয়েছে। এটা মহিলারাও জেনে রাখুন। আর ডাক্তারবাবুরাও বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে এর ব্যবহার করে দেখতে পারেন।”

বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা দেবারতি চিকিৎসার জন্য সেই শহরের পাট চুকিয়ে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যা থাকা দেবারতির গর্ভধারণ করতেই একাধিক সমস্যা ছিল। সেই সব সমস্যা পেরিয়ে তিনি যদিও বা গর্ভধারণ করতেন, তা-ও মাস কয়েকের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যেত। প্রথম বার সাড়ে চার মাস, দ্বিতীয় বার সাড়ে পাঁচ মাস, আর তৃতীয় বার সাড়ে সাত মাসে পৌঁছে গর্ভপাত হয়ে যায় তাঁর। ২০০৫ সাল থেকে চিকিৎসা চলছিল। প্রায় ১০ বছরের চেষ্টায় কোলে সন্তান আসে তাঁর।

কিন্তু কেন হয় সার্ভাইকাল ইনকমপিটেন্স? চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, কারও কারও ক্ষেত্রে বিষয়টা জন্মগত। কারও ক্ষেত্রে কোনও অস্ত্রোপচারের পরে জরায়ু ঢিলে হয়ে যায়। আবার শরীরে কলোজেন নামে একটি বিশেষ প্রোটিনের ঘাটতি হলেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।

স্ত্রী রোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সাধারণত বার বার গর্ভপাত এড়াতে যোনিমুখে শিরোদগার বা ম্যাকডোনাল্ড স্টিচ করা হয়। তাতেও কাজ না হলে আমাদের শেষ অস্ত্র এটা। এ ক্ষেত্রে ল্যাপরোস্কোপি করে বা পেট কেটে জরায়ুমুখটা উপর থেকে সেলাই করে দেওয়া হয়।”

এই প্রক্রিয়ার সাফল্যের হার যথেষ্ট ভাল। কিন্তু একটি সমস্যাও রয়েছে। সেটা কী? অভিনিবেশবাবু বলেন, “যদি গর্ভস্থ ভ্রূণ কোনও কারণে মারা যায়, সে ক্ষেত্রে ফের অস্ত্রোপচার করে সেলাই কেটে ভ্রূণ বার করতে হয়। সহজ প্রক্রিয়ায় সেটা সম্ভব হয় না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement