বাজার ছেয়ে গিয়েছে পাকা আমে। কিন্তু তার স্বাদ নেহাতই পানসে। পুরুষ্টু পাকা পেঁপে। কিন্তু কাটার পরে দেখা গেল ভিতরটা বিশ্রী রকমের কাঁচা। পাকা কলার খোসা ছাড়িয়ে কামড় বসাতেই টের পাওয়া গেল কলা মোটেই পাকেনি। ক্রেতা ঠকানোর এই ফিকিরে এক শ্রেণির ফল ব্যবসায়ী বহু বছর ধরেই হাতিয়ার করছেন কার্বাইডকে। ইদানীং সেই প্রবণতা বাড়ছে। ফল ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশই স্বীকার করছেন, প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে এ ছাড়া পথ নেই। কিন্তু কার্বাইডে পাকানো ফল খেলে শরীরে পুষ্টি তো যায়-ই না, উপরন্তু এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
পোশাকি নাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড। হাওয়ার সংস্পর্শে এলে কার্বাইড থেকে অ্যাসিটিলিন নামে এক ধরনের গ্যাস বেরোয়। তার উত্তাপেই ফল পেকে যায়। ওই গ্যাসই লোহার কারখানায় লোহা কাটতে ব্যবহার হয়।
কী ভাবে ফল পাকানো হয় কার্বাইডে? মেছুয়া ফলপট্টির এক ব্যবসায়ী জানালেন, আমের ৫০ টনের বড় বাক্সে ১০০ গ্রামের মতো কার্বাইড ভরে দেন তাঁরা। কখনও আবার ছোট একটা ঘরের মেঝেতে ফল বিছিয়ে ঘরে নির্দিষ্ট পরিমাণে কার্বাইড ভরে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কলকাতা ফ্রুট মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক শাহিদ আহমেদ খান বলেন, “মূলত পাইকারি ব্যবসায়ীরাই এটা করেন। ফল পাকার সময় দেন না। নিয়ম অনুযায়ী, রাইপনিং চেম্বার-এ ফল পাকানোর কথা। কিন্তু তা মানতে গেলে যথাযথ পরিকাঠামো চাই। সেটা এ রাজ্যে কোথায়? সরকারি তরফে এ ব্যাপারে আরও প্রচার দরকার।” বহু ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ভিন্ রাজ্য থেকে যখন ট্রাকে করে ফল আসে, তখন সেই ট্রাকেই তাঁরা কার্বাইড দিয়ে রাখেন। আসার পথে ফল পেকে যায়। তবে বেশি দেরি হয়ে গেলে আবার ফল পচে যাওয়ার ভয়ও থাকে।
ফল পাকানোর একটা বিকল্প পদ্ধতিও রয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। বড়বাজারের এক ফলবিক্রেতা বলেন, “ইথাইলিন মিশ্রণে ফল ডুবিয়ে রাখা হয়। তার পরে বরফ ঠান্ডা জলে চুবিয়ে ‘এয়ার টাইট’ বাক্সে ভরে রাখা হয়। এতে দিন কয়েকেই ফল পেকে যায়।”
শিয়ালদহের এক ব্যবসায়ীর কথায়, “একটা ছোট চেম্বার করতে গেলেও অন্তত ছ’সাত লক্ষ টাকা খরচ। কোথা থেকে অত টাকা পাব? কাঁচা মাল তাড়াতাড়ি পাকাতে তাই এ ছাড়া পথ নেই।” বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, কার্বাইডে পাকানো ফল নিয়মিত খেলে ফল হতে পারে মারাত্মক। মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া, পাকস্থলীর নানা সংক্রমণের পাশাপাশি কার্বাইড থেকে ক্যানসারও হতে পারে বলে আশঙ্কা চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশের। অন্তঃসত্ত্বারা একটানা কার্বাইডে পাকানো ফল খেলে সন্তান কিছু অস্বাভাবিকতা নিয়ে জন্মাতে পারে।
বিজ্ঞানী উৎপল সান্যাল বলেন, “পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ কার্বাইডের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে এর ক্ষতিকর প্রভাবের কারণেই। বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে এই রাসায়নিক।”
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “কার্বাইডে পাকানো ফল খেলে কী ধরনের ক্যানসার হতে পারে, তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ বা তথ্যপঞ্জি এখনও নেই। কিন্তু বহু দেশ থেকেই নানা খবর আসছে। সুতরাং সতর্ক থাকা দরকার।”
কাগজে-কলমে খাবারে কার্বাইড ব্যবহার নিষিদ্ধ। ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড ব্যবহার করলে জরিমানা তো বটেই, ছ’মাসের জেলও হওয়ার কথা। কিন্তু কোথাও-ই তা মানা হয় না। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “বিপদটা ঠিক কোথায় এবং কতটা তা আমরা বুঝি। কিন্তু এটা ঠেকানোর পরিকাঠামো আমাদের নেই। সাধারণ মানুষকেই সচেতন হতে হবে।”
কী ভাবে সচেতন হবেন মানুষ? ওই কর্তার কথায়, “ফল খাওয়ার আগে ভাল ভাবে ধুয়ে নেওয়া উচিত। খোসা সমেত ফল না খাওয়াই ভাল। নির্দিষ্ট মরসুমের আগেই কোনও ফল কেনা উচিত নয়।” এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে স্বাস্থ্য দফতরের তরফে কোনও প্রচারের ব্যবস্থা নেই কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।