কাজে ফাঁকি দেওয়া এবং হাসপাতালে কম অস্ত্রোপচার করার অভিযোগে জেলা স্তরে এক সঙ্গে ৭৯ জন সরকারি চক্ষু চিকিৎসককে কারণ দর্শানোর নোটিস ধরিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। জেলা, মহকুমা ও স্টেট জেনারেল হাসপাতালের ওই চিকিৎসকেরা সরকারি হাসপাতালে কম সময় দিতেন বলে অভিযোগ।
রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে-র কথায়, “সরকারি হাসপাতালের এক-এক জন চক্ষু বিশেষজ্ঞের বছরে অন্তত ৫০০টি ছানি অস্ত্রোপচার করার কথা। কিন্তু দেখা গিয়েছে ২০১২-১৩ সালে ওই ৭৯ জন ডাক্তারের কেউই ৭০-১৫০-র বেশি অস্ত্রোপচার করেননি। মাত্র ১০-১৫টি অস্ত্রোপচার করেছেন এমন ডাক্তারও রয়েছেন।”
স্বাস্থ্য দফতরের এই সিদ্ধান্ত জেনে সরকারি চিকিৎসকদের বামপন্থী সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টরস’-এর সভাপতি গৌতম মুখোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, “শুধু বিশেষজ্ঞদের দোষ দেখলে হবে!” তাঁর দাবি, জেলায় সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের জন্য ভাল সরকারি আবাসন নেই। হাসপাতালে তাঁদের কাজের যথাযথ পরিবেশ নেই। গ্রাম থেকে রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য সরকারি ভাবে অপথ্যালমিক অ্যাসিস্ট্যান্ট নামে একটা পদ আছে। তাঁরা থাকলে অনেক রোগী হাসপাতালে আসার সুযোগ পান। কিন্তু বহু অপথ্যালমিক অ্যাসিস্ট্যান্ট পদ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এ সব প্রসঙ্গ তুলে গৌতমবাবুর বক্তব্য, “সেই সব খামতিগুলো দেখা হচ্ছে না কেন?”
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী অবশ্য বলেছেন, “পরিকাঠামোর খামতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। ওটা চিরকাল ছিল। ও সব মানিয়ে নিয়েই কাজ করতে হবে। না হলে শাস্তি পেতে হবে।”
অন্য সরকারি কর্মীদের মতো সরকারি চিকিৎসকদেরও সপ্তাহে ছ’দিন অন্তত সাত ঘণ্টা করে মোট ৪২ ঘণ্টা কাজ করার কথা। স্বাস্থ্যসচিব জানান, এমন অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে হাতেনাতে ধরা হচ্ছে, যাঁরা গোটা সপ্তাহ ১২-১৪ ঘণ্টার বেশি ‘ডিউটি’ করছেন না। যে কোনও সময়ে ডাকলে পাওয়া যাবে (‘অন কল’) দেখিয়ে তাঁরা হাসপাতালে হাজির হচ্ছেন না। সেই সময়টা এঁদের অনেকেই বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করছেন।
স্বাস্থ্যসচিবের কথায়, “প্রথমে চোখের চিকিৎসকদের দিয়ে ফাঁকি ধরার কাজ শুরু হল। এর পর জেলা স্তরে স্ত্রীরোগ, সার্জারি, মেডিসিন, শিশু বিশেষজ্ঞের মতো প্রত্যেকেরই ‘পারফরমেন্স’ যাচাই করা হবে।” তিনি জানান, হাসপাতালগুলি থেকে বিশেষজ্ঞদের ‘ডিউটি-রস্টার’ চেয়ে পাঠানো হয়েছে স্বাস্থ্যভবনে। কোন চিকিৎসক সপ্তাহে কোন দিন, কত ক্ষণ হাসপাতালে থাকছেন তা দেখার জন্য স্বাস্থ্যভবনে এক অফিসারের উপরে আলাদা করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সব চেয়ে বেশি সংখ্যক চোখের ডাক্তারকে শো-কজ করা হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনায়, ১৮ জন। তার পরেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার ১০ জন। এ ছাড়া, তালিকায় বীরভূম ও দার্জিলিঙের ৬ জন করে, হুগলির ৫ জন, বর্ধমান, হাওড়া, দুই মেদিনীপুর, নদিয়া ও দক্ষিণ দিনাজপুরের ৪ জন করে, পুরুলিয়ার ৩ জন, জলপাইগুড়ি ও মুর্শিদাবাদের ২ জন করে এবং কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর ও মালদহের ১ জন করে রয়েছেন।
অভিযুক্ত চিকিৎসকদের অনেকেই অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কমার জন্য কেন্দ্রের ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা’র (আরএসবিওয়াই) দিকে আঙুল তুলেছেন। বিপিএল কার্ডধারীরা বছরে ৩০ টাকা দিয়ে ওই প্রকল্পের সুবিধা পেতে পারেন। সরকারি চিকিৎসকদের আর একটি সংগঠন ‘সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম’-এর সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাস বলেছেন, “আরএসবিওয়াই কার্ডধারী রোগীদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ছানি কাটাতে যাচ্ছেন। আরএসবিওয়াইয়ে চোখের অস্ত্রোপচারের জন্য নির্ধারিত আর্থিক প্যাকেজ বেশ আকর্ষণীয়, তাই বেসরকারি হাসপাতালও এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তারা এজেন্টও লাগাচ্ছে।”
স্বাস্থ্য-কর্তারা পাল্টা জানিয়েছেন, আরএসবিওয়াই প্রকল্পে বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে অনেক বেশি ছানি অস্ত্রোপচার হয়েছে এটা যেমন ঠিক, তেমনই দফতরের প্রাথমিক তদন্তে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে ওই অস্ত্রোপচারের বেশির ভাগই করছেন সরকারি চোখের ডাক্তারেরা। কারণ, এর জন্য বেসরকারি হাসপাতালে তাঁরা রোগীপ্রতি ৬০০ টাকা উৎসাহ-ভাতা (ইনসেনটিভ) পান। বেসরকারি হাসপাতালে বেশি সংখ্যায় অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে সরকারি হাসপাতালে তাঁরা কম অস্ত্রোপচার করছেন। এই অবস্থায় চিকিৎসকদের শো-কজের পাশাপাশি, বেসরকারি হাসপাতালে আরএসবিওয়াই প্রকল্পের আওতায় ছানি অস্ত্রোপচারের দৈনিক সংখ্যা বেঁধে দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।