রোগীর সঙ্কট কাটানোর জন্য চিকিৎসক আছেন। কিন্তু চিকিৎসকের নিজস্ব সঙ্কটও কিছু কম নয়।
শহরের নামী চিকিৎসকরা নিজেরাই কবুল করলেন এই সমস্যার কথা। কত রকম দ্বন্দ্ব আর দোটানার মধ্যে দিয়ে তাঁদের যেতে হয়, সে সব কথা নিজেরাই খোলাখুলি বললেন ওঁরা। স্বীকার করলেন, “এতে অনেক সময় অনিচ্ছাকৃত ভাবে যেমন রোগীর ক্ষতি হয় তেমনই সমস্যায় পড়তে হয় আমাদের নিজেদেরও।”
শনিবার জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিলনস কিডনি ফাউন্ডেশন আয়োজন করেছিল ‘ল ইন মেডিসিন’ শীর্ষক এক আলোচনাচক্রের। সেখানেই চিকিৎসা সংক্রান্ত আইন নিয়ে আলোচনার সূত্র ধরেই উঠে এল এমন নানা প্রসঙ্গ।
ভাস্কুলার সার্জন কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় বলছিলেন মনোবিদ ডেভিড শ্যন-এর করা একটি সমীক্ষার কথা। শ্যন সমীক্ষা করে দেখেছিলেন, এক জন অর্থনীতিবিদ হয়তো কোনও বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন। তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন, বিশ্লেষণ করছেন তার পর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছেন। এবং সেই অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি স্থির করছেন। কিন্তু এক জন চিকিৎসকের হাতে সেই সময় থাকে না। রোগের কারণ সম্পর্কে চিন্তা করতে করতেই তাঁকে রোগীর চিকিৎসা শুরু করে দিতে হয়। অর্থাৎ তাঁর চিন্তা ও কাজ একসঙ্গে চলে এবং তাতে ভুলের সম্ভাবনা বাড়ে।
কৃষ্ণেন্দুবাবুই জানান, এক জন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মস্তিষ্কে একসঙ্গে ২০ লক্ষ তথ্য থাকতে পারে। হয়তো একজন রোগীকে পরীক্ষা করতে করতে তিনি উপসর্গগুলিকে কোনও রোগের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করছেন, ভাবছেন অতীতে এই রকম রোগী দেখেছেন কিনা এবং রোগীর দু’তিনটি শারীরিক সমস্যা চিহ্নিত করে তার ভিত্তিতে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করছেন।
এই শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেই নানা দোটানা আর ভুলভ্রান্তির মধ্যে পড়েন চিকিৎসকরা। কৃষ্ণেন্দুবাবুর অভিজ্ঞতায়, কোনও চিকিৎসক কোনও রোগীর ওষুধের ক্ষেত্রে একবার ভুল করলে অনেক সময় অতিরিক্ত সচেতন হয়ে থাকেন। অন্য কোনও রোগীর ক্ষেত্রে ওই ওষুধ প্রয়োজন মনে হলেও দিতে ইতস্তত করেন বা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। আবার অনেক সময় চিকিৎসক নিজে মানসিক ও শারীরিক ভাবে ক্লান্ত থাকেন বা নতুন প্রযুক্তির চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সড়গড় নন বলে কিছু ভুল করে ফেলেন।
কোনও রোগীর মস্তিষ্কের মৃত্যু হলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা এবং লাইফসাপোর্ট বন্ধ করার ক্ষেত্রেও চিকিৎসক যথেষ্ট দোনামনায় ভোগেন। চিকিৎসক সন্দীপা ভট্ট ব্যাখ্যা করছিলেন, সামাজিক ভাবে চিকিৎসককে জীবনদাতা হিসেবে দেখা হয়। তিনি যে কোনও মূল্যে রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করার শপথ নেন। হয়তো রোগীর আত্মীয়েরা ভেন্টিলেশন সরিয়ে নেওয়ার অনুমতি দিয়েও দিলেন। কিন্তু চিকিৎসকের মনে খচখচ করতে থাকে যে, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য আত্মীয়েরা এটা করছেন না তো? রোগীর সহায়ক চিকিৎসা বন্ধ করার জন্য পরে কেউ ডাক্তারকে দায়ী করবেন না তো? চিকিৎসক সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় আবার লক্ষ করেছেন, চিকিৎসকেরা যে পরিভাষায় কথা বলেন, সেটা থেকে রোগীর পরিবারের সঙ্গে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। পরিবারের লোকজন অনেক সময় চিকিৎসকের কথার অর্থ বুঝতে পারেন না। সন্দীপবাবুর মতে, পরিভাষাগত জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ চিকিৎসকদেরই খুঁজে নিতে হবে। যেমন রোগীর ‘মস্তিষ্কের মৃত্যু’ হয়েছে না-বলে ‘রোগীর মৃত্যু হয়েছে’ বললে বুঝতে সুবিধা হবে। রোগী ‘লাইফ সাপোর্ট’ এ আছে না-বলে ‘মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন’-এ আছে বললেও ধন্দ কাটানো যাবে।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ গৌতম খাস্তগীর বলছিলেন, গর্ভপাত ও সারোগেসি সংক্রান্ত দোটানার কথা। যেমন কোথাও স্ত্রী হয়তো গর্ভপাত চান কিন্তু স্বামী চান না। আইন মায়ের পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু চিকিৎসক সেই মুহূর্তে কার পাশে দাঁড়াবেন তা ঠিক করতে সমস্যায় পড়তে হয়। গৌতমবাবু জানান, অনেক সময় সামান্য কারণ দেখিয়ে স্বামী-স্ত্রী গর্ভপাত চান। এক জন ডাক্তার হিসেবে তখন মানসিক চাপে পড়তে হয়। আবার গর্ভাবস্থায় মা হয়তো না জেনে এমন একটা ওষুধ খেয়ে ফেলেছেন, যাতে গর্ভজাত সন্তান প্রতিবন্ধী হতে পারে। এই রকম পরিস্থিতিতে সন্তান নষ্ট করা হবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নিতে ডাক্তারবাবুকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। সারোগেসির ক্ষেত্রে সন্তানের জন্মের পর বাবা-মা তাকে কোনও কারণে না নিতে চাইলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েন চিকিৎসকই।