আপন ভাগ্য জয়ের যুদ্ধে নিজের সইয়ে লুম্বিনী থেকে মুক্তি

দরকার একটা ছোট্ট সইয়ের। নিজে করলে হবে না। চাই কোনও আত্মজনের সই। কিন্তু শুধু সেটুকুর অভাবে মনোরোগী সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও নিজের ঠিকানায় ফিরতে পারেন না অনেক ক্ষেত্রেই। এত দিনে নিজের মুক্তির ছাড়পত্রে নিজে সই করার অধিকার পেলেন সুস্থ হয়ে যাওয়া ওই সব মানুষজন। সেই সইয়ের ভিত্তিতে মানসিক হাসপাতাল থেকে রোগীদের ছুটি দেওয়ার ব্যাপারে নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিতে পারল রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরও।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:২৬
Share:

মীরা বিশ্বাস

দরকার একটা ছোট্ট সইয়ের। নিজে করলে হবে না। চাই কোনও আত্মজনের সই। কিন্তু শুধু সেটুকুর অভাবে মনোরোগী সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও নিজের ঠিকানায় ফিরতে পারেন না অনেক ক্ষেত্রেই।

Advertisement

এত দিনে নিজের মুক্তির ছাড়পত্রে নিজে সই করার অধিকার পেলেন সুস্থ হয়ে যাওয়া ওই সব মানুষজন। সেই সইয়ের ভিত্তিতে মানসিক হাসপাতাল থেকে রোগীদের ছুটি দেওয়ার ব্যাপারে নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিতে পারল রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরও।

সুস্থ হওয়ার পরেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানসিক হাসপাতাল থেকে অনুমতিপত্রে সই করে নিকটজনকে ফিরিয়ে নিতে চান না অনেকে। সেই জন্য রোগীর মুক্তিপত্রে সইয়ের জন্য তাঁদের দেখা মেলে না। এত দিন সেই সইয়ের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হত সুস্থ হয়ে যাওয়া মানুষটিকে। সই করার মতো আত্মীয়ের দেখা না-পেয়ে অসহায়ের মতো রোগীকে আটকে রাখতে বাধ্য হতেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষও। সেই বাধা কাটানোর নজির হয়ে রইল কলকাতার লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতাল। সেখানকার এক রোগিণীর আবেদনের ভিত্তিতে তাঁকে ছেড়ে দিয়ে। স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে, কবে আত্মীয়েরা দয়া করে এসে সই করে নিয়ে যাবেন, সেই অপেক্ষায় জীবন পার করার দিন শেষ। এ বার থেকে সব মানসিক হাসপাতালেই রোগীকে ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর নিজের সইয়ের নিয়মই মানা হবে।

Advertisement

আইন কী বলছে?

মানসিক স্বাস্থ্য আইনের ৪৩ নম্বর ধারায় বলা আছে, রোগী যদি আবেদন করেন এবং মেডিক্যাল বোর্ড যদি বিচার করে দেখে যে, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ, তা হলে তাঁকে নিজের দায়িত্বেই ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এত দিন এই আইন প্রয়োগে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি স্বাস্থ্য দফতরকে। অবশেষে বিজয়গড়ের মীরা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পেরেছে স্বাস্থ্য দফতর। সুস্থ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁর পরিবার দীর্ঘদিন তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়নি। মীরাদেবীর ব্যক্তিগত আবেদনের ভিত্তিতেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হল মঙ্গলবার।

রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “আমি লিখিত ভাবে সব মানসিক হাসপাতালে জানিয়ে দিয়েছি, এ বার থেকে এই নিয়ম মেনে চলতে হবে।” তাঁর বক্তব্য, সুস্থ হয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে মানসিক ভাবে অসুস্থদের মধ্যে ফেলে রাখা যায় না। এটা অমানবিক। বাড়ির লোক হয়তো দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। অন্য কেউ সেই মানুষটির ভার নিতে চাইলে এবং তিনি নিজে আবেদন করলে তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে।

স্বামী নরেন্দ্র বিশ্বাসের আচমকা মৃত্যুর পরে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ১৯৯৫ সালে মীরাদেবীকে পিকনিক গার্ডেনের লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন বাড়ির লোকজন। তিন-চার বছর পরে অর্থাৎ ২০০০ সাল নাগাদ তিনি সুস্থ হয়ে যান। তা সত্ত্বেও পরিবারের তরফে তাঁকে বাড়ি ফেরাতে কেউ আগ্রহ দেখাননি বলে অভিযোগ। অজয়নগরে থাকেন তাঁর ছেলে মৃদুল বিশ্বাস। লুম্বিনীর সুপার তপন টিকাদার জানান, মৃদুলবাবুকে দীর্ঘদিন ধরে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন।

সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও দীর্ঘ ১৪ বছর হাসপাতালে পড়ে থাকাটা ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠছিল বছর পঁয়ষট্টির মীরাদেবীর কাছে। শেষ পর্যন্ত ২৪ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিকর্তার কাছে নিজেই চিঠি লিখে মুক্তি চান তিনি। এত দিন এই ধরনের আবেদন পেলে চুপ করে থাকত স্বাস্থ্য দফতর। এ বার ব্যতিক্রমী হয়ে উঠে ইতিবাচক ভূমিকা নেয় তারা। ২৬ ডিসেম্বর লুম্বিনীর সুপার তপন টিকাদার, চিকিৎসক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক মল্লিক, সুব্রত মল্লিককে নিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড বসে। তারা মীরাদেবীর চিকিৎসার ইতিহাস ও কাগজপত্র খতিয়ে দেখে রায় দেয়, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। তার পরেই বিশ্বাস পরিবারের অনুমতির অপেক্ষা না-করে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় স্বাস্থ্য দফতর।

এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, প্রায় ২০ বছর হাসপাতালে থাকার পরে ছাড়া পেয়ে একটি মানুষ কোথায় যাবেন? বিশেষত যখন তাঁর আত্মীয়েরা তাঁকে নিতে চাইছেন না?

তপনবাবু জানান, এ ব্যাপারে আগে থেকেই ব্যবস্থা করা আছে। ওই হাসপাতালে সরকারি অনুমতির ভিত্তিতে যে-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করে, তারাই পাইকপাড়ার বাসিন্দা রূপশ্রী রায় নামে এক মহিলার বাড়িতে কেয়ারটেকার হিসেবে মীরাদেবীর চাকরির ব্যবস্থা করেছে। সংগঠনের তরফে শুক্লা দাসবরুয়া জানান, রূপশ্রীদেবীর সঙ্গে লিখিত চুক্তি করে মীরাদেবীর মাসিক বেতন ঠিক হয়েছে এবং মাসে এক বার মীরাদেবীকে হাসপাতালে চেক-আপে আনতে সম্মত হয়েছেন রূপশ্রীদেবী। তিনি এ দিন দুপুরেই হাসপাতালে এসে মীরাদেবীকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, “উনি আমার পরিবারের অংশ হয়েই থাকবেন।”

স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জনবাবুর কথায়, “যে-ভাবে সরকারি মানসিক হাসপাতালে ফেলে রাখা সুস্থ রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল, তাতে একটু সাহসী হয়ে এই পদক্ষেপ আমাদের করতেই হত। নইলে আর কোনও শয্যা খালি হবে না। নতুন কেউ ওই সব হাসপাতালে ভর্তিও হতে পারবেন না।” তিনি জানান, আইনে রোগীর আবেদনের বিষয়টি বিবেচনার কথা বলাই আছে। তাই কোনও অসুবিধা নেই। মানসিক রোগীদের অধিকার আন্দোলনে যুক্ত রত্নাবলী রায়ের ব্যাখ্যা, দেরিতে হলেও সরকার শেষ পর্যন্ত মানসিক হাসপাতালে ‘ভলান্টারি ডিসচার্জ’ প্রক্রিয়া চালু করল। এটা প্রশংসনীয়। সুস্থ হওয়ার পরেও বাড়ির লোক অনুমতি দিচ্ছে না বলে একটি মানুষ মানসিক হাসপাতালে আটকে থাকবেন, এটা চলতে পারে না।

কিন্তু মাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মৃদুলবাবু সই করতে চাননি কেন?

“মাকে বাড়ি ফেরালে পরিবারের অন্যেরা আমাকে বাড়ি থেকে বার করে দিতেন,” জবাব পুত্রের।

শুনে মুখ অন্ধকার হয়ে যায় মীরাদেবীর। মাথা নিচু করে বলেন, “আমার আবেদনে স্বাস্থ্য দফতর সাড়া দিয়েছে, এটাই অনেক। অনাত্মীয়েরাই এখন থেকে আমার আপনজন।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement