গরমে, ভিড়ে অপেক্ষাই ভবিতব্য। এসএসকেএমের আউটডোরে। ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী
কাতারে কাতারে মানুষ। ধাক্কাধাক্কি আর দরদর করে ঘামতে ঘামতে একটা ঘরে দমবন্ধ করা অপেক্ষা। কেউ বসার সুযোগ পেয়েছেন। কেউ পাননি। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মেঝেতেই বসে পড়েছেন অনেকে। তাঁদের মাড়িয়েই চলে যাচ্ছেন অন্যেরা। বহু ঘরেই পাখা খারাপ। যেখানে পাখা চলছে, সেখানেও তার গতি এমনই কম যে, হাওয়া গায়ে লাগছে না বললেই চলে। অনেকেরই ঘরে জায়গা হয়নি। তাঁরা দাঁড়িয়ে ঠা-ঠা রোদের মধ্যে। পানীয় জলের কল রয়েছে বটে, কিন্তু তার জন্যও হাঁটতে হয় বেশ খানিকটা। অপেক্ষা করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। শুধু রোগী নন, ডাক্তারদের অবস্থাও তথৈবচ। অসহ্য গরমে প্রায় বধ্যভূমির চেহারা নিয়েছে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের আউটডোর।
রোগীরা প্রতিদিন এ নিয়ে অভিযোগ করছেন, কিন্তু তাঁদের কথা কানে তোলার কেউ নেই। এ বার বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তারেরাও জানাচ্ছেন, বিপুল রোগীর ভিড়ে কাজ চালিয়ে যেতে গেলে তাঁদের ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যটুকু দরকার, যা এই মুহূর্তে কার্যত সব সরকারি হাসপাতালেই অমিল। দিন কয়েক আগেই সুপার স্পেশ্যালিটি এসএসকেএম হাসপাতালে রোগী দেখতে দেখতে আউটডোরেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন দুই চিকিৎসক।
এসএসকেএমের সার্জারি বিভাগের ওই দুই চিকিৎসকের অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পৌঁছেছে স্বাস্থ্য ভবনেও। শুধু সার্জারি নয়, মেডিসিন, গাইনি, রিউম্যাটোলজির আউটডোরেও ভিড়ে পিষ্ট হওয়ার অবস্থা। যে বড় ঘরগুলোতে কয়েকশো মানুষ ঠাসাঠাসি হয়ে অপেক্ষা করেন, সেখানে অনেক জায়গাতেই পাখা খারাপ হয়ে পড়ে। ভোটের কাজে পূর্ত দফতরের ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের ৯৫ শতাংশেরও বেশি কর্মীকে তুলে নেওয়া হয়েছে। তাই সেগুলো সারানোরও কেউ নেই।
এসএসকেএমের রিউম্যাটোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক অলোকেন্দু ঘোষ বলেন, “এই পরিস্থিতিতে সকলেরই নাভিশ্বাস উঠছে। আমরা প্রশাসনকে জানিয়েছি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকলে রোগী-ডাক্তার সকলের পক্ষেই সমস্যা হয়ে উঠছে। ওঁরাও চেষ্টা করছেন। কিন্তু রাতারাতি তো কিছু করা যাবে না। তত দিন রোগীদের বলছি, প্রচুর পরিমাণ জল খান। না হলে অপেক্ষা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”
বনগাঁ থেকে আসা তনিমা মাইতি পাল্টা প্রশ্ন তুললেন, “বেশি জল খেলে তো আমাদের আরও বিপদ। বাথরুমে যাওয়ার দরকার হলে কী করব? এত বড় হাসপাতাল। অথচ আমাদের এ সব প্রয়োজনে যাওয়ার মতো কোনও ভদ্রস্থ ব্যবস্থাই নেই।”
একই পরিস্থিতি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, নীলরতন সরকার, ন্যাশনাল মেডিক্যাল, আর জি কর সর্বত্রই। সব চেয়ে খারাপ অবস্থা ক্যানসার রোগীদের। রেডিয়েশন নেওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় তাঁদের প্রায় সবাইকেই। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ওই রোগীরা গরমে অপেক্ষা করতে করতে আরও কাহিল হয়ে পড়ছেন। দিন কয়েক আগেই এনআরএসে দুই ক্যানসার রোগী রেডিয়েশনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে বা বসে থেকে প্রায়ই বমি করে নেতিয়ে পড়ছেন একাধিক রোগী।
আর জি করের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, দূরদর্শিতা আর যথাযথ পরিকল্পনার অভাবেই এমন অবস্থা হচ্ছে। গত ৫০ বছরে যে হারে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে, সেই হারে পরিকাঠামো বাড়েনি। বেশির ভাগ হাসপাতালেই পুরনো আউটডোর বিল্ডিংয়ে মলিন, দমচাপা ঘরে রোগী দেখা হয়। তাঁর কথায়, “রোগীদের মানুষ হিসেবে ভাবার মানসিকতাটা এখনও তৈরি হয়নি।”
মেজেনাইন ফ্লোরের একটা ঘরে রেডিওথেরাপির আউটডোর চলে আর জি করে। ঘরে আলো-বাতাস চলাচলে জায়গা নামমাত্র। রাস্তার ধারে জানলা রয়েছে, সেখান দিয়ে অনবরত ধুলো আর হাওয়ার গরম হল্কা হাওয়া ঢোকে। চিকিৎসার অপেক্ষায় বসে থাকা রোগী ও তাঁদের পরিজনেরা নিজেদের ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে চলেন অনবরত।
কী ভাবছে স্বাস্থ্য ভবন? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। কিন্তু সমস্ত আউইটডোরে এসি বসানো সম্ভব নয়। বেশির ভাগই পুরনো আমলের বাড়ি। সেখানে কোন কোন জায়গায় এসি বসানো যাবে, কোথায় যাবে না, তা নিয়ে পূর্ত দফতরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তা ছাড়া বেছে বেছে একটা-দুটো হাসপাতালের আউটডোরে স্বাচ্ছন্দ্য দিলে তো চলবে না, সব হাসপাতালের কথাই ভাবতে হবে।”
তা হলে উপায় কী? সুশান্তবাবু বলেন, “পাখার সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। পানীয় জলের কলের সংখ্যাও বাড়ানোর কথা ভাবা হয়েছে। এ ছাড়া রোদে যাতে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়, সেই কারণে শেড-এর সংখ্যাও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
লাল ফিতের বাঁধন পেরিয়ে এটুকু ব্যবস্থা কবে হয়, আপাতত তারই অপেক্ষায় রয়েছেন রোগীরা।