অঙ্গ প্রতিস্থাপনে সমন্বয় কেন্দ্র এসএসকেএমেও

কিডনি পাচার এবং কিডনি প্রতিস্থাপনে দালাল-চক্র বন্ধে ফের ‘মুশকিল আসান’-এর সন্ধান পেল পশ্চিমবঙ্গ। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রকের দেওয়া সেই সুযোগ রাজ্য নিতে পারবে কি না এ বার উঠছে সেই প্রশ্ন। কারণ, পরিকাঠামো এবং কর্মসংস্কৃতি। কী সেই সুযোগ? কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য দরকার এক জন দাতা। সেই দাতা বলতে বহু দিন পর্যন্ত জীবিত ব্যক্তিকেই ধরে নেওয়া হত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বেশ কয়েক বছর আগেই মৃতদেহ থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আইন তৈরি করে বিভিন্ন রাজ্যের সামনে নতুন সুযোগ করে দিয়েছে।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৪ ০২:৪৭
Share:

কিডনি পাচার এবং কিডনি প্রতিস্থাপনে দালাল-চক্র বন্ধে ফের ‘মুশকিল আসান’-এর সন্ধান পেল পশ্চিমবঙ্গ। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রকের দেওয়া সেই সুযোগ রাজ্য নিতে পারবে কি না এ বার উঠছে সেই প্রশ্ন। কারণ, পরিকাঠামো এবং কর্মসংস্কৃতি।

Advertisement

কী সেই সুযোগ?

কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য দরকার এক জন দাতা। সেই দাতা বলতে বহু দিন পর্যন্ত জীবিত ব্যক্তিকেই ধরে নেওয়া হত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বেশ কয়েক বছর আগেই মৃতদেহ থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আইন তৈরি করে বিভিন্ন রাজ্যের সামনে নতুন সুযোগ করে দিয়েছে। কেন্দ্রের ওই নিয়ম ইতিমধ্যেই সর্বস্তরে কার্যকর করে সাড়া ফেলেছে তামিলনাড়ু। নিয়মটি কাগজে-কলমে কার্যকর করেছে পশ্চিমবঙ্গও। কিন্তু তার প্রয়োগ নামমাত্র। তাই এখনও এ রাজ্যে কিডনি-পাচার চক্রের রমরমা।

Advertisement

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

এই ব্যর্থতা সত্ত্বেও চক্ষুদান আন্দোলনে অগ্রণী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে অঙ্গ পাচার রুখতে আরেকটি সুযোগ করে দিতে চায় স্বাস্থ্যমন্ত্রক। অঙ্গ প্রতিস্থাপনে দালাল-চক্রের রমরমা বন্ধে এসএসকেএম হাসপাতাল-সহ দেশের পাঁচটি হাসপাতালে বিশেষ সমন্বয় কেন্দ্র তৈরি করছে কেন্দ্র। কলকাতা ছাড়া নয়াদিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই ও গুয়াহাটিতে ওই সমন্বয় কেন্দ্রগুলি তৈরি হবে। ওই আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলির অধীন রাজ্যগুলিতে কোথাও অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে হলে ওই কেন্দ্রকে তা প্রথমে জানাতে হবে। সেই কেন্দ্রের অনুমোদন পেলে তবেই অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যাবে।

রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারাও মানছেন, জীবিত মানুষের দেহ থেকে অঙ্গ নেওয়া বন্ধ হয়ে গেলে পাচারের আশঙ্কা কমবে। অন্য দিকে, সমন্বয় কেন্দ্রের কড়া নজরদারির জন্য জীবিত দাতার পরিচয়ের ক্ষেত্রেও কারচুপি করা যাবে না। ফলে, দালালচক্র অন্য কাউকে আত্মীয় সাজিয়ে নিয়ে এসে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে পারবে না।

কিন্তু এই ভাল উদ্যোগ নিয়েও প্রশ্ন ওঠার কারণ কী?

কারণ, রাজ্যের পরম্পরা। স্বাস্থ্য-কর্তাদেরই একাংশ বলছেন, এখানে সব কিছুই ঘটা করে চালু হয়। কিন্তু শেষমেষ পরিকাঠামোর অভাবে তা মুখ থুবড়ে পড়ে। স্কিন-ব্যাঙ্ক চালু হলেও যথাযথ পরিকাঠামোর অভাবে শুরুতেই তা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। চোখ সংরক্ষণের পরিকাঠামো এখনও নানা জায়গাতেই বেহাল। মাতৃদুগ্ধের সংরক্ষণ ব্যবস্থাও তথৈবচ। মানুষকে সচেতন করে এগিয়ে আসতে উৎসাহী করার ব্যাপারেও এখানে তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

তা হলে তামিলনাড়ু কী ভাবে এটা পারল? সেখানকার স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে তাঁদের পথ দেখিয়েছেন কাঞ্চিপুরমের চিকিৎসক দম্পতি অশোকন এবং আর পুষ্পাঞ্জলি সুব্রমণি। তাঁদের সন্তান হিতেন্দ্রন ২০০৮ সালে এক মোটরবাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। তিন দিন পরে তাঁর ‘ব্রেন ডেথ’ হয়। ওই পরিস্থিতিতেই সন্তানের দেহ থেকে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করার সিদ্ধান্ত নেন সুব্রমণি দম্পতি। হিতেন্দ্রনের হৃৎপিণ্ড পায় ন’বছরের একটি মেয়ে। লিভার, কর্নিয়া এবং কিডনি পেয়ে নতুন জীবন পান আরও পাঁচ জন। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেই তামিলনাড়ুতে জোয়ার আসে মৃতদেহ থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কাজে।

আর পশ্চিমবঙ্গ? বছর দশেক আগে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সহায়তায় দু’টি বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে যৌথ ভাবে একটি সমন্বয় কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল। ‘ব্রেন ডেথ’-এর পরেও কৃত্রিম উপায়ে যদি রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখা যায়, তা হলে তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, লিভার, কিডনি ইত্যাদি সচল থাকে। সেই অবস্থায় ওই ব্যক্তির দেহ থেকে প্রয়োজনীয় অঙ্গ তুলে প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করার কথা ছিল ‘অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন কো-অর্ডিনেশন সেন্টার’ নামে ওই কমিটির। ‘ব্রেন ডেথ’-এর পরেই যাতে প্রয়োজনীয় অঙ্গ মৃতের শরীর থেকে তুলে নেওয়া যায় সে ব্যাপারে জনমত গড়া এবং সেই সঙ্গে তার বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে সমন্বয় গড়ার দায়িত্ব ছিল কমিটির উপরে। কিন্তু কাজের কাজ বিশেষ হয়নি।

কেন? ওই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত, এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্ণধার ব্রজ রায় বলেন, “চোখ সংগ্রহের ব্যাপারে যেমন লাগাতার প্রচার চলে, অঙ্গ সংগ্রহ নিয়েও তেমনই কাজ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেন্দ্র বা রাজ্যের তরফে তেমন সাড়া পাইনি।”

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারাও কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, “অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য আঞ্চলিক কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে, তা খুবই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কিন্তু অঙ্গ সংরক্ষণের জন্য ব্যাঙ্ক তৈরি করতে হবে। এখানে কিডনি আর চোখ ছাড়া, সরকারি পরিকাঠামোয় অন্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নেই। সে সব কবে চালু হবে, তা-ও কেউ জানে না।”

তবে এতটা হতাশ নন এসএসকেএম তথা ‘ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র। তিনি বলেন, “যে কোনও প্রকল্পেই শুরুর দিকে সমস্যা, প্রতিরোধ থাকে। এ ক্ষেত্রেও থাকবে। কিন্তু পাচার-চক্র যদি রুখতে হয়, তা হলে এ ছাড়া অন্য পথ নেই।”

এসএসকেএম-এর ইউরোলজি বিভাগের প্রধান অনুপ কুণ্ডুুর কথায়, “কলকাতাকে এখন কিডনি-পাচার চক্রের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কোটি কোটি টাকার লেনদেন। অন্য রাজ্য থেকে লোকজন এখানে এসে কিডনি প্রতিস্থাপন করিয়ে যাচ্ছেন, কারণ, এখানে কিডনি ‘সুলভ’।” নতুন ব্যবস্থায় এ সব বন্ধ হবে বলে মনে করছেন অনুপবাবুও। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, “তামিলনাড়ু পারলে, আমরাও পারব।”

ইউরোলজিস্ট অমিত ঘোষের বক্তব্য, দৃঢ়তা এবং দ্রুততার সঙ্গে সব কিছু করতে হবে। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের তথ্য সংবলিত অন-লাইন ব্যবস্থা চালু রাখা জরুরি। মৃতদেহ থেকে অঙ্গ নিতে হলে পরিবহণের যথাযথ সুবিধা থাকতে হবে। তিনি বলেন, “২৪ ঘণ্টার পরিষেবা থাকতে হবে। ‘আজ হবে না, কাল আসুন’ জাতীয় মনোভাব নিয়ে চলার জায়গা নেই এ ক্ষেত্রে।” আর মৃতদেহের অঙ্গ নিয়ে যাতে ব্যবসা শুরু না হয় সে দিকেও খেয়াল রাখার কথা বলেছেন অমিতবাবু। তাঁর বক্তব্য, মৃতদেহ থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন যথাযথ ভাবে কার্যকর করতে গেলে শুধু কিডনি বা চোখ নয়, হৃৎপিণ্ড, লিভার, ফুসফুস প্রতিস্থাপনের পরিকাঠামো থাকাও জরুরি, যা না থাকলে সংগৃহিত অঙ্গের অপচয় হওয়ার ভয় ষোলো আনা।

তামিলনাড়ুতে ওই প্রকল্পের যিনি কর্ণধার, সেই আমালুরপাভানাথনের গলাতেও একই সুর। তিনি বলেন, “এমন একটা উদ্যোগ সফল করতে হলে সংশ্লিষ্ট সমস্ত স্তরে তৎপরতা দরকার। যাবতীয় পরিকাঠামো তৈরি করে তবেই কাজ শুরু করা উচিত। যাতে কোনও দান, ব্যর্থ না হয়।”

এ রাজ্যে সেটা কি কখনও করা যাবে? সংশয় কাটছে না স্বাস্থ্য দফতরের কর্তা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আন্দোলনকারীদের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement