যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিপদ সম্পর্কে ইদানিং আলোচনার শেষ নেই। প্রকৃত পরিস্থিতি আরও কতটা ভয়ঙ্কর, এ বার তার হদিস দিল খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকে জমা পড়া ওই রিপোর্ট বলছে, দেশে নবজাতক-মৃত্যুর অন্যতম কারণ হল, শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্ষমতা (রেজিস্ট্যান্স) জন্মে যাওয়া। যার পিছনে নির্বিচারে অ্যন্টিবায়োটিক প্রয়োগের ভূমিকা বিরাট।
বিশ্বপ্রসিদ্ধ মেডিক্যাল জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়েছে হু’র সেই রিপোর্ট। যার খতিয়ান অনুযায়ী, ‘অ্যন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’-এর শিকার হয়ে গত বছর ভারতে ৫৮ হাজার শিশু মারা গিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রক তাই এ বার সমস্ত রাজ্যকে সতর্ক করেছে। মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য: শুধু জেলায় জেলায় সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ) খুলে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। একেবারে গোড়ার দিকের স্বাস্থ্য-বিধিগুলো মেনে চলায় জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সম্পর্কে প্রচার চালাতে হবে ডাক্তার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।
নবজাতক-মৃত্যুর সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকের সম্পর্কটা উঠে আসছে ঠিক কী ভাবে?
হু-র রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স) জেরে যে সব শিশু মারা গিয়েছে, তারা ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ নিয়েই জন্মেছিল। ডাক্তারবাবুরা তাদের উপরে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেছিলেন। কোনওটাই কাজে আসেনি। এবং এরই কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের দিকে আঙুল উঠছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, দরকারে-অদরকারে খেয়াল-খুশিমতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রবণতা এখন এমন পর্যায়ে যে, বহু অ্যান্টিবায়োটিক কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে।
ফল হচ্ছে মারাত্মক। বেশ কিছু বড় ধরনের অসুখে , যেমন সেপসিস, ডায়েরিয়া, নিউমোনিয়া ও মূত্রনালির সংক্রমণে অনেকের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। রোগী যদি শিশু হয়, তা হলে ব্যাপারটা আরও ভয়াবহ, কেননা শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এমনিতেই খুব কম।
অত্যধিক অ্যন্টিবায়োটিকের কুপ্রভাব যে কতটা, সে সম্পর্কে হু-রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে সতর্কতা। স্পষ্ট জানানো হয়েছে, এই কারণেই ডাক্তারেরা শিশুদের সাধারণ সংক্রমণ রুখতেও মাঝে-মধ্যে যথেষ্ট বেগ পাচ্ছেন। আবার প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, মূত্রনালির সংক্রমণে ভুগে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া রোগী পরবর্তী সময়ে ওষুধে তেমন সাড়া দিচ্ছেন না। কারণ, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না-করে তাঁরা অল্প সময়ের ব্যবধানে এত ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে রোগ সারানোর চেষ্টা করেছেন যে, শরীর বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। পরিণামে দুর্ভোগ বাড়ছে। নিরাময়যোগ্য অসুখও শরীরে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকছে।
নিওনেটোলজিস্ট অরুণ সিংহের মুখেও শোনা গিয়েছে হুঁশিয়ারি। নবজাতকের চিকিৎসায় ‘পুরুলিয়া মডেলে’-এর প্রণেতা এই চিকিৎসক জানাচ্ছেন, অনেক সময়ে হাসপাতালের ভিতরেই ব্যাক্টেরিয়া জন্ম নেয়। শিশু-শরীরে সংক্রমিত একাধিক ব্যাক্টেরিয়া মিলে কিংবা একটি বা্যক্টেরিয়াই হয়তো চরিত্র পাল্টে এমন চেহারা নিল, যা কিনা অ্যন্টিবায়োটিককে প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে। একে বলা হয় ‘সুপারবাগ।’ অরুণবাবুর কথায়, “নবজাতকের শরীরে এনডিএম-১ নামে এমন ব্যাক্টেরিয়া প্রথম ধরা পড়েছিল এসএসকেএমের নিওনেটোলজি বিভাগে। এখন গোটা বিশ্বে তা নিয়ে চর্চা চলছে।” রক্ষার উপায় কী?
অরুণবাবুর দাওয়াই, “স্বাস্থ্যকর অভ্যেসগুলো বাড়াতে হবে, যাতে ব্যাকটেরিয়া তৈরিই হতে না পারে। ভীষণ জরুরি অ্যান্টিবায়োটিক নির্ভরতা কমানো। মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তাদেরও অভিযোগ, অধিকাংশ হাসপাতাল অ্যান্টিবায়োটিক-নীতির বালাই রাখছে না। ফার্মাকোলজি-র বিশেষজ্ঞেরাও জানাচ্ছেন, অধিকাংশ জায়গায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রোটোকল মানা হয় না। কোন পর্যায়ে রোগীকে কী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে, তার সুনির্দিষ্ট নীতিকে বলে অ্যান্টিবায়োটিক প্রোটোকল। দেখা গিয়েছে, এক-এক হাসপাতালে এক-এক ধরনের সংক্রমণের প্রকোপ বেশি। সেই অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক স্থির করা উচিত। কিন্তু তার তোয়াক্কা না-করে গোড়া থেকেই সর্বোচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের ফলে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠছে বলে বিশেষজ্ঞেরা আক্ষেপ করছেন।
যেমন কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজি-র প্রধান চিকিৎসক বলছেন, “নিয়ম অনুযায়ী, হাই ডোজের কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের আগে বিশেষ কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন। অবাধ ব্যবহার ঠেকাতেই নিয়মগুলো করা হয়েছিল। অথচ অধিকাংশ ডাক্তার তা জানেনই না!” সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতির দিকেও আঙুল উঠছে। “ওঁরা হামেশা ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা না-করে ওষুধ কিনে খান। তাই তাঁদের মধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়া জন্ম নেয়। পরে অন্যদের মধ্যে ছড়ায়।” মন্তব্য এক বিশেষজ্ঞের। শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ জানিয়েছেন, ভয়াবহ সংক্রমণ নিয়ে বহু বাচ্চা তাঁদের কাছে আসছে। কোনও ওষুধে সুস্থ করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, “পরিবেশে যেমন জীবাণু ছড়ায়, তেমন হাসপাতালের পরিকাঠামো পরিচ্ছন্ন না-থাকলেও শরীরে জীবাণু ঢুকতে পারে।”
পশ্চিমবঙ্গে নবজাতক-মৃত্যু প্রতিরোধের লক্ষ্যে সরকার গঠিত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, এসএনসিইউয়ে পরিচ্ছন্নতার দিকে তাঁরা অনেক বেশি জোর দিচ্ছেন। তাই এ রাজ্যে নবজাতকের মৃত্যু-হার খানিকটা কমানো গিয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক যদিও এ ক্ষেত্রে কোনও রাজ্যের উল্লেখযোগ্য সাফল্য এখনও নজর করতে পারছে না। নয়াদিল্লির বক্তব্য: বিভিন্ন রাজ্যের হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট) ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে শুধু ‘ই কোলাই’ প্রায় ৩০%। মূত্রনালির অন্যান্য সংক্রমণ, ভেন্টিলেটর অ্যাসোসিয়েটেড নিউমোনিয়া এবং রক্ত বা স্যালাইনের চ্যানেল থেকে ছড়ানো সংক্রমণও কম কিছু নয়।