শীত পড়ছে, কী ভাবে সতর্ক থাকবেন জানেন?

বেশ কিছু দিন ধরেই শীতের আমেজ অনুভূত হচ্ছে। হঠাৎ আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে অনেকেই বিশেষত বাচ্চা ও বয়স্করা সহজে মানিয়ে নিতে পারছেন না। এই পরিবর্তনের সময়ে অনেকেই নানা অসুখে ভুগতে শুরু করেন। শীত শুরুর সময়ে নানা অসুখ-বিসুখ মানুষকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দেয়। যেমন সর্দি-কাশি-হাঁচি ও নিঃশ্বাসে কষ্ট। এ সময় কারও ঠান্ডাজনিত সমস্যা হলে তা সহজে সারতে চায় না। কারও কারও অ্যালার্জি সমস্যা বাড়ে। শীতকালীন বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে আলোকপাত করলেন চিকিৎসক আনন্দ মণ্ডল।শীতে বাতাস ভারী থাকে। সেই কারণে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস বাতাসের নীচের স্তরে নেমে আসে। এর ফলে মানুষের শরীরে চট করে ভাইরাস ঢুকে যায়। এর জন্য ভাইরাস জনিত রোগ শীতে বেশি হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:১৬
Share:

রোগী দেখছেন চিকিৎসক। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

প্রশ্ন: শীতকালে কী ধরনের অসুখ বেশি হয়?

Advertisement

উত্তর: শীতে বাতাস ভারী থাকে। সেই কারণে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস বাতাসের নীচের স্তরে নেমে আসে। এর ফলে মানুষের শরীরে চট করে ভাইরাস ঢুকে যায়। এর জন্য ভাইরাস জনিত রোগ শীতে বেশি হয়। ছোট বা বয়স্করা যাঁদের ইমিউনিটি ক্ষমতা কম তাঁরা সহজে আক্রান্ত হন। এ ছাড়া শীতকালে মস্তিষ্কে এবং হৃদয়ে রক্তচলাচলকারী নালী সংকোচন বেশি মাত্রায় হয় তাই হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক শীতকালেই বেশি হয়। ব্রঙ্কাইটিস বাড়ে। বড়দের রক্ত চাপ বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া শিশুদের ভাইরাল ডায়রিয়াও হয়।

প্রশ্ন: ভাইরাল ডায়রিয়া কী? কেন হয়?

Advertisement

উত্তর: ভাইরাল ডায়রিয়া সাধারণত রোটা ভাইরাস থেকে হয়। আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ধরণের রোগের জীবাণু এবং ভাইরাস বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যা সংক্রমিত হলে শিশুদের পাশাপাশি বড়রাও রোগাক্রান্ত হয়। রোটা ভাইরাস হচ্ছে রিওভাইরাইড পরিবারের একটি ভাইরাস। রোটা ভাইরাস মুখগহ্বর দিয়ে খাদ্যনালীতে প্রবেশ করে। সংক্রমিত হওয়ার পর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এর উৎস পানীয় জল, আগের দিন খাবার। বাচ্চাদের এই রোগ বেশি হয়। ভাইরাল ডায়রিয়া হলে প্রথমে বমি এবং পরে পাতলা পায়খানা হয়। সঙ্গে জ্বর এবং পেটব্যথা। এর ফলে শরীরে জলশূন্যতা দেখা দেয়। সময় মতো চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। জলশূন্যতা দূর করার জন্য ঘন ঘন স্যালাইন দিয়ে পূরণ করতে হবে। রক্তের মধ্যে খনিজ লবণের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। এই ভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পেতে গেলে বাইরে থেকে এসে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। হাত মুখ ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে।

প্রশ্ন: ভাইরাস জ্বরের জন্য কী কী করা উচিত?

উত্তর: আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাস জ্বরের অবির্ভাব ঘটে। শীতকালে ভাইরাস জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। বিভিন্ন ভাইরাস যেমন-অ্যাডিনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি মূলত ভাইরাস জ্বরের জন্য দায়ী। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও যাদের শরীরে অন্য রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস আছে, তাদের এই জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম, প্রচুর তরল জাতীয় খাবার, বিশেষ করে বেশি জল খাওয়া দরকার। ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অন্যদের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন। না হলে সংক্রমণের ভয় থাকে।

প্রশ্ন: শীতে অ্যালার্জি ও অ্যাজমার সংক্রমণ বেশি কেন?

উত্তর: শীতকালে অ্যালার্জি ও অ্যাজমা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। অ্যালার্জি ও অ্যাজমা রোগ দুটি অনেক ক্ষেত্রে একসঙ্গে হয়, যদিও কোনওটির প্রকাশ আগে হতে পারে। বারবার সর্দি-হাঁচি-কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বুকে চাপ সৃষ্টি করে ও আওয়াজ হয়। এ সময় ঠাণ্ডা লাগার প্রবণতা বেড়ে যায়। এ ছাড়াও বাতাস শুষ্ক থাকে। বাতাসে ধূলিকণা থাকে। সেক্ষেত্রে ব্যকটেরিয়া মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। সেগুলির প্রতিক্রিয়া থেকে অ্যালার্জি হয়। যেসব কারণে অ্যালার্জি হয় সেসব থেকে দূরে থাকা জরুরি। প্রয়োজনে অ্যালার্জির ওষুধ, নাকের স্প্রে এবং বিশেষ ক্ষেত্রে ইনহেলারও ব্যবহার করতে হতে পারে।

প্রশ্ন: অ্যাজমা কী ?

উত্তর: এটি শ্বাস প্রশ্বাস জনিত রোগ। আমাদের শ্বাসনালীর অতি সংবেদনশীলতার কারণে অ্যাজমা বা হাঁফানি হয়। অ্যাজমার ফলে শ্বাসনালীর স্বাভাবিক ব্যাস কমে গিয়ে আগের থেকে সরু হয়ে যায়। যার ফলে ফুসফুসে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে না। দেহে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। ধূমপান এবং অন্যান্য তামাকজাত দ্রবাদি ব্যবহার করলে অ্যাজমা বাড়ে। এ ছাড়া ধূলাবালি, কারখানার ধোঁয়া, বিষাক্ত গ্যাসের জন্য অ্যাজমা হয়। অ্যাজমা রোগীদের ক্ষেত্রে অবশ্যই বুকের এক্সরে করে দেখা দরকার অন্য কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কি না। অ্যাজমা রোগীদের ম্যাগনেসিয়াম খাবার বেশি খেতে হবে। ধূমপান বন্ধ করতে। বায়ূদূষণ, ধূলো থেকে সরে থাকতে হবে। ধোঁওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।

প্রশ্ন: ধূলিকণা এই রোগগুলোর ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব বিস্তার করে ?

উত্তর: বাতাসের ধূলিকণা শ্বাসনালীতে চলে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে গলা ফোলা, গাল ফোলা, শ্বাস কষ্ট এবং হাঁফানি ও অ্যালার্জি হয়। ধূলিকণা থেকে বাঁচতে নাকে মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে । অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ বাতাস বইছে এমন পরিবেশে থাকতে হবে।

প্রশ্ন: এ বার এই ধরনের রোগীর সংখ্যা কেমন?

উত্তর: মএখনও শীত জাঁকিয়ে আসেনি। তবুও এখনই দৈনিক গড়ে ২০ জন ব্রঙ্কাইটিস রোগী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হচ্ছেন। ভাইরাল ডায়েরিয়াতেও শিশুরা আক্রান্ত হয়ে গড়ে দু’তিন জন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এ ছাড়া হার্টের অসুখ তো রয়েইছে।

প্রশ্ন: হার্টের অসুখগুলি কি কি?

উত্তর: মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন, ঘন ঘন বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি। শীতের সময় অনেকে আবার সাইনোসাইটিসের সমস্যায়ও ভোগেন। সাইনোসাইটিসের লক্ষণ হতে পারে বারবার মাথা ধরা, সর্দি-কাশির প্রবণতা, কাশতে কাশতে বমি, জ্বর।

প্রশ্ন: শীতে ফুসেফুসেও সংক্রমণ ঘটে কী?

উত্তর: শীতের সময় ফুসফুসে সংক্রমণের সমস্যায় অনেকেই ভোগেন। ফুসফুসের সংক্রমণকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক সংক্রমণ যা সাধারণত ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। আর লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক সংক্রমণ যা ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। তবে ভাইরাল নিউমোনিয়াও হতে পারে। জ্বর, কাশি, কফ, শরীর ব্যথা ও বমি বমি ভাব হলো ফুসফুস সংক্রমণের লক্ষণ। তবে ভাইরাল নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে সর্দি-হাঁচি, নাক দিয়ে জলও পড়তে পারে। ফুসফুসে এক ধরনের ইনফেকশন হল ব্রঙ্কাইটিস। ব্রঙ্কাইটিসে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহকারী ট্যিসু (ব্রঙ্কিয়াল ট্রি) বেড়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস ঘটিত হয়। তবে ব্যাকটেরিয়া থেকেও ব্রঙ্কাইটিস হয়। ব্রঙ্কাইটিসের লক্ষণ হল কাশি। কাশতে গেলে বুকে ব্যথা সঙ্গে জ্বর হয়। চারপাশের ধূলোবালি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সমস্যা ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্তদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ব্রঙ্কাইটিস আক্রান্তদের অনেক সময় স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহারে ব্লাড প্রেসারও বাড়তে পারে।

প্রশ্ন: শীতকালে খাবারের ক্ষেত্রে কোনও সতর্কতা আছে?

উত্তর: তেমন নেই । তবে বাসি ভাত, বেগুন, চিংড়ি, মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। ম্যাগনেসিয়াম জাতীয় খাবার বেশি করে খান। সবুজ শাকের মধ্যে ম্যাগনেসিয়াম বেশি থাকে। বাদাম, কুমড়োর বীজ, পেস্তা, কাঠ বাদাম , সূর্যমুখীর বীজে ম্যাগনেসিয়াম বেশি থাকে। মাছ, কলা এবং ডার্ক চকলেটে ম্যাগনেসিয়াম থাকে। ম্যাগনেসিয়াম শরীর সুস্থ রাখে। ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার খেলে শরীরে হৃৎপিণ্ড সচল থাকে, ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রিত হয়। ম্যাগনেসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। ক্লান্তি, নিদ্রাহীনতা, মানসিক চাপ দূর করে। এ ছাড়া মাইগ্রেনের ব্যথাও ম্যাগনেসিয়াম জাতীয় খাবারে দূর হয়।

প্রশ্ন: শিশু ও বয়স্কদের জন্য বিশেষ কোনও পরামর্শ?

উত্তর: শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গরম জামা-কাপর পরাতে হবে। বয়স্করা ধূমপান থেকে বিরত থাকুন। প্রয়োজন ছাড়া রাতের দিকে বাইরে না বেরনোই ভাল।

সাক্ষাৎকার: অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement