Year End Special

কোভিড অন্তত তিনটি ইতিবাচক শিক্ষা দিয়েছে

রেস্তোঁরায় গিয়ে কি আমরা এমন সব ওয়েটার দেখব, যারা পরিবেশন করবে মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে। এমন ভাবে যে, তাদের মুখটাও দেখা যাবে না?

Advertisement

শিলাদিত্য চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০০
Share:

করোনা কালে খাবার-দাবার

রেস্তোঁরা কি হাসপাতালের মতো দেখতে হবে? নাকি সেটা হওয়া উচিত? ২০২০ সাল কি আমাদের সেটাই বলে গেল?

Advertisement

রেস্তোঁরায় গিয়ে কি আমরা এমন সব ওয়েটার দেখব, যারা পরিবেশন করবে মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে। এমন ভাবে যে, তাদের মুখটাও দেখা যাবে না? নাহ্, আমি তেমন মনে করি না। আমি মনে করি, বাঙালি রেস্তোঁরায় যায় আনন্দ পেতে, প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে কিছু ভাল মুহূর্ত কাটাতে। সেখানে যদি আতঙ্ক থাকে, পরিবেশটা দেখে হাসপাতাল-হাসপাতাল মনে হয়, তাহলে আমার অস্বস্তি হবে। পছন্দ হবে না। রেস্তোঁরায় খাওয়াটা তো একটা সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা। নিত্যদিন নতুন-নতুন রেস্তোঁরায় নতুন-নতুন অভিজ্ঞতা।

যেমন নতুন অভিজ্ঞতা কোভিডের। বাঙালি বেজায় ভোজনরসিক। অন্তত কলকাতার প্রেক্ষিতে। বাঙালি আনন্দে বা উৎসবে যেমন খেতে ভালবাসে, তেমনই দুঃখও ভোলে খাবার দিয়ে। কিন্তু কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ সেই বাঙালির দুনিয়াটা একেবারে ওলটপালট করে দিল! আমাদের মতো রেস্তোঁরা ব্যবসায়ীদের জীবনও পাল্টে গিয়েছে ২০২০ সালে। লকডাউনের সময় তিন সপ্তাহ পর থেকে প্রশাসন রেস্তোঁরা থেকে হোম ডেলিভারির অনুমতি দিয়ে দিয়েছিল। আড়াই-তিন মাসের ভিতর রেস্তোঁরাও খুলে দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে আমরা একটা নুতন দুনিয়ায়, নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে শিখেছি। অনুভূতির সঙ্গেও সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছি। জেনেছি, জীবন আর যথাপূর্বম নেই। এই ধ্রুব সত্যটা মানতে হবে। এখনও মনে করতে পারি না যে, সবকিছু অবিকল আগের মতো হয়ে যাবে। সেটা একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ততদিন এই বদলটাকে সঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে। যেমন ভোজনরসিক বাঙালি হাসপাতালের মতো দেখতে রেস্তোঁরার চেহারাও মেনে নিয়েছে। খেতে আসছে। ভাবা যায়?

Advertisement

ব্যক্তিগত ভাবে চিরকাল ইতিবাচক থেকেছি। করোনা অতিমারির সময়েও। অন্তত তিনটে ‘পজিটিভ’ দিক আমার নজরে পড়েছে।

প্রথমত, মানবসম্পদ বা হিউম্যান রিসোর্সেএ বিনিয়োগ করার জন্য এটা সেরা সময়। কারণ, বহু মানুষ গত ৯ মাসে চাকরি হারিয়েছেন। এখনও হারাচ্ছেন। এই কঠিন সময়ে যদি কাজের মানুষকে বেছে রেখে দেওয়া যায়, তাহলে তাঁরা যে কোনও প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্পদে পরিণত হতে পারেন। আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাপেক্ষে এটা খুব দৃঢ় ভাবে মনে করি। এই কোভিডের সময়েও গত সাত-আট মাসে আমরা দুটো নতুন রেস্তোঁরা খুলেছি। সাদার্ন অ্যাভিনিউ আর নাকতলায় । তিন-চার মাসের মধ্যে আরও একটা রেস্তোঁরা খুলতে চলেছি উত্তর কলকাতায়। অনেকেই অবাক। অন্যরা যখন ব্যবসা গোটাচ্ছেন, তখন আমরা বাড়াচ্ছি কেন! বাড়াচ্ছি, কারণ আমরা লম্বা ইনিংস খেলতে এসেছি। কোভিড তো সাময়িক ব্যপার। হয়তো কিছুদিন বেশি মন্দা চলবে। একদিন না একদিন তো দুনিয়া এর থেকে বেরোবেই। আমরাও বেরোব। সেই সব দিনের দিকে তাকিয়ে মানবসম্পদে এই বিনিয়োগ। কিছুদিন ব্যক্তিগত বিলাসিতা বা স্বচ্ছলতা ছাড়তে হবে। কিন্তু জীবন নামক এই ম্যারাথনে, রেঁস্তোরা ব্যবসার মতো লম্বা দৌড়ের খেলায় আমরা মাথায় জয়ের আবির মেখেই ফিরব।

দ্বিতীয়ত, রিয়েল এস্টেট। রেস্তোঁরার ব্যবসা তো শুধুমাত্র রেস্তোঁরার ব্যবসা নয়। তার সঙ্গে রিয়েল এস্টেট ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জায়গা কেনা, জায়গা ভাড়া নেওয়া ইত্যাদি। কারণ, ভাল ‘প্রপার্টি’ মানে ভাল জায়গা না হলে ভাল রেঁস্তোরা হতে পারে না। ২০২০ সালের এই অতিমারি পরিস্থিতি রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করে ভাল রেস্তোঁরা বানানোর সুযোগ করে দিয়েছে। অনেক কম দামে ভাল ‘প্রপার্টি’ কেনার সুযোগ করে দিয়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাস।

তৃতীয়ত, হোম ডেলিভারি বা সুইগি-জোম্যাটোর মতো অ্যাপে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে গিয়ে খাবার খাওয়ার প্রবণতার সাঙ্ঘাতিক রকমের বাড়বৃদ্ধি। রেস্তোঁরায় এসে বেশি লোজন খাচ্ছএন না। ঠিকই। কিন্তু হোম ডেলিভারিতে অর্ডার করে বাড়িতে খাচ্ছেন। একশ্রেণির মানুষের মধ্যে এটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি হয়ে গেল। যেটা পরবর্তীকালে রেস্তোঁরা ব্যবসায় সুফল দেবে। দিতে বাধ্য। যাঁরা রেস্তোঁরায় গিয়ে খেতে পছন্দ করেন, তাঁরা কোনও না কোনও সময় রেস্তোঁরায় ফিরে আসবেনই। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি আমাদের এক নতুন শ্রেণির ক্রেতা বা খাদ্যরসিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে। যাঁরা হোম ডেলিভারিতেই স্বচ্ছন্দ। কোভিডের সময়ে অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে হোম ডেলিভারি কিন্তু একটা সাংঘাতিক জায়গা করে নিয়েছে। হয়তো এখন সেটা আমাদের চোখে পড়ছে না। তার একটা কারণ হতে পারে ২২-২৫ শতাংশ কমিশন বিভিন্ন অ্যাপ বা অনলাইন ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মগুলোকে দিয়ে দিতে হচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই হোম ডেলিভারির ক্রেতারা আমাদের সঙ্গে থেকে যাবেন। তার সঙ্গে ‘ফাইন ডাইনিং’ বিক্রিটাও আবার ফিরে আসবে। এটা হল রেস্তোঁরা ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদি লাভ।


চতুর্থ আরও একটা দিক আছে। করোনার শিক্ষা আমাদের স্বাস্থ্য বা পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়েও অনেকটা বদলে দিয়েছে। মানুষ এখন অনেক স্বাস্থ্যসচেতন। যে ভোজনরসিকরা রেস্তোঁরায় ঢুকছেন, তাঁরা পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অনেক সতর্ক। ভারতীয় খাবার যেহেতু হাত দিয়ে খেতে হয়, তাই হাত ধুয়ে খাওয়া, খাওয়ার আগে হাত ভাল করে স্যানিটাইজ করে নেওয়া— এগুলো সব অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। যাঁরা রেঁস্তোরা ব্যবসায় ‘হাই কোয়ালিটি’ দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাঁদের জন্য ক্রেতাদের এই সচেতনতা খুব ভাল। আর সত্যি বলতে কী, শুধু ক্রেতারা তো নযন, যাঁরা রান্নাঘরে কাজ করেন, খাবার পরিবেশন করেন, তাঁরা সকলেই এখন এই সব বিষয়ে ভীষণ সতর্ক।

২০২০ সালটা মনে রাখব এই তিনটে খুব জরুরি শিক্ষার জন্য। ইতিবাচক। শিক্ষণীয় এবং সুদূরপ্রসারী।

আরও পড়ুন: বছর শেষে পার্টি, মদ্যপানের মাত্রা ঠিক থাকছে তো?

আরও পড়ুন: ‘দেদার উৎসব পালনের এত সাহস কোথা থেকে’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement