ধোঁয়া না এড়াতে পারলে অসুখ পৌঁছে যাবে ফুসফুস পর্যন্ত। —নিজস্ব চিত্র।
ধূমপানের নেশা না করেও কিংবা বাড়তি নুন না খেয়েও শরীরে একই রকম ক্ষতি হতে পারে। এবং তা শুধুমাত্র বায়ুদূষণের কারণে! বিভিন্ন গবেষণা থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এমন প্রমাণ পেয়েছেন। পরীক্ষানিরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্তদের এক তৃতীয়াংশ মানুষের অসুখের নেপথ্যে আছে বায়ুদূষণ।
শহর হোক অথবা মফস্সল, প্রচুর পরিমাণে অটো, বাইক ও গাড়ি চলার কারণে এর থেকে নিঃসৃত পার্টিক্যুলেট ম্যাটার (পিএম), নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড ও কয়লার ধোঁয়া- পেট্রোলের ধোঁয়ায় থাকা সালফার ডাই অক্সাইড এবং গাড়ির ধোঁয়া থেকে নিঃসৃত পল্যিউট্যান্ট সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির সঙ্গে বিক্রিয়া করে তৈরি করে ওজোন গ্যাস। এগুলির প্রতিটিই আমাদের শরীরের জন্যে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর।
বিশেষত পার্টিক্যুলেট ম্যাটার অত্যন্ত সূক্ষ্ম হওয়ায় আমাদের শ্বাসনালী দিয়ে সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছে যায়। আর ওখানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। এই পার্টিক্যুলেট ম্যাটার জমতে শুরু করলে সিওপিডি অর্থাৎ ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের সূত্রপাত হয়। ফুসফুসের কাজকর্ম কমতে শুরু করে। শরীর প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পায় না। সামান্য পরিশ্রমেই হাঁফিয়ে উঠতে হয়। কাজ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। ক্রমশ ফুসফুসের বায়ুথলি বা অ্যালভিওলাই শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। সামান্য হাঁটাচলা করতে গেলেও দম বেরিয়ে যায়। অক্সিজেনের অভাবে হাঁসফাঁস করতে হয়। বারে বারে ফুসফুসের সংক্রমণ হয়। নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ে, ঘন ঘন হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
আরও পড়ুন: সব ডিম এক বারে চাই, তাই হাঁস মারলে ক্ষতি কী!
ধোঁয়ার পার্টিক্যুলেট ম্যাটার ফুসফুসে জমে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ ডেকে আনে।
বাতাসে ভেসে থাকা ২.৫ মাইক্রন অথবা তাঁর থেকেও ছোট পার্টিক্যুলেট ম্যাটার আমাদের শরীরের জন্যে সাংঘাতিক ক্ষতিকর। প্রথমত এরা রক্তস্রোতে মিশে গিয়ে রক্তবহনকারী ধমনীকে ক্রমশ সরু করে দেয়। ফলে রক্ত চলাচল বাধা পায়। এর ফল হার্টের অসুখ ও ব্রেন স্ট্রোক। ফুসফুসে জমে থাকা পিএম ক্যানসারের একটা বড় কারণ। নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড ও সালফার ডাই অক্সাইড শ্বাসের সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে ও শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অ্যাজমা অর্থাৎ হাঁপানির অন্যতম কারণ ওজোন গ্যাস। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে শিশুদের মধ্যে হাঁপানি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ এখানকার দূষিত বাতাস।
ইউনিসেফ-এর এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে, বিশ্ব জুড়ে শিশুদের অ্যাজমার ঝুঁকি ভয়ানক ভাবে বেড়ে চলেছে। ৫–১৮ বছর বয়সিদের মধ্যে ১৪ শতাংশ অ্যাজমার শিকার। প্রতি বছর বায়ু দূষণের জন্য পাঁচ বছরের কমবয়সি পাঁচ লক্ষাধিক শিশু শ্বাসনালীর অসুখে মারা যায়। ইদানীং শিশুদের মধ্যে ক্যানসারের ঝুঁকিও খুব বাড়ছে। এর জন্যও দায়ী দূষণ।
তবে দূষণ হানায় বড়রাও নিরাপদে নেই। প্রত্যকে বছর বিশ্বের ৭০ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছেন স্রেফ দূষিত পরিবেশের কারণে। শুধু যে রাস্তার গাড়ির ধোঁয়া-ধুলোয় আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি তা নয়, ঘরের দূষণ অর্থাৎ রান্নার আগুনের ধোঁয়া, ফোড়নের ঝাঁজ, মশা অথবা কীটনাশক ধুপের অত্যধিক ব্যবহার এবং স্প্রে এবং রুম ফ্রেশনার থেকেও আমাদের অন্দরমহল দূষিত হয়ে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ঘরের মধ্যের দূষণের কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে শিশু ও বয়স্কদের মৃত্যুর হার ক্রমশ বাড়ছে।
আরও পড়ুন: একা থাকা মহিলাদের খুঁজে বার করে খুন, কালনার সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে কী বলছেন মনোবিদরা?
রাস্তায় বেরলে মাস্ক ব্যবহার করুন। ছবি: শাটারস্টক।
তাই জেনে রাখা দরকার কী ভাবে এড়ানো যায় এ সব।
বাইরে বেরলে চেষ্টা করুন মাস্ক ব্যবহার করতে। কলকাতার রাস্তাঘাটে বিশেষ করে সব সময়ই মাস্ক প্রয়োজন বলে মত বিশেষজ্ঞদের। খুব ধুলো-ধোঁয়ার জায়গা এড়িয়ে চলুন। ঘরের ভিতর এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করতে পারলে ভাল। বাড়ির পরিবেশ দূষণ মুক্ত রাখা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। ধূপ-ধুনোর ধোঁয়ায় রাশ টানুন। কখনও তা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়। সুগন্ধি রুম ফ্রেশনারের পরিবর্তে টাটকা ফুল ব্যবহার করা যেতে পারে। মশা-মাছি সরাতে প্রাকৃতিক উপায়ে ঘরসা রাখুন, মশার ধূপে নয়। রান্নার সময় কম আঁচে চাপা দিয়ে রান্না করলে ফোড়নের ঝাঁজ বশে থাকে। স্মোকড ও ভাজার বদলে সেদ্ধ ও বেক করা খাবার খেলে ভাল। প্রত্যেকে বাড়িতে যদি কিছু গাছ লাগাতে পারেন, তাতেও কিছুটা বিশুদ্ধ অক্সিজেনের জোগান বাড়বে।