বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের নির্দিষ্ট ফর্মুলা হয়, যার বাইরে বেরোনো যায় না। মেডিক্যাল সায়েন্স তা নয়। একটা বিষয়েই নানা মত। তার উপরে নিরন্তর গবেষণা ক্রমাগত বদল আনতে থাকে বিষয়ে। কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কিংও এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে চিকিৎসক মহল একমত নয়। কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক করা উচিত কি না, এতে আসলে কোনও কাজ হয় কি না, বিতর্ক রয়েছে তা নিয়েও। উল্টো দিকে এর মাধ্যমে সুফল পেয়েছেন এমন মানুষও আছেন।
গোড়ার কথা
কথাতেই আছে, মায়ের সঙ্গে শিশুর নাড়ির যোগ। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে আম্বিলিক্যাল কর্ড। এই কর্ডের মধ্যেই ৫০০ থেকে ৭০০ মিলিলিটার রক্ত থাকে। সেই রক্তে থাকে স্টেম সেল। এই রক্তই সংরক্ষণ করা হয়। স্টেম সেল হল রক্তের আদি কোষ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, বোন ম্যারোয় থাকা অপরিণত কোষই স্টেম সেল। এই কোষ আলাদা আলাদা ভাবে রক্তে লোহিতকণিকা, শ্বেতকণিকা, অনুচক্রিকা তৈরি করতে পারে। যে প্রক্রিয়াকে বলা হয় হিম্যাটোপোয়েসিস। এর সাহায্যে সুস্থ মানুষের শরীরে প্রত্যেক দিন ২০ হাজার নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয়। বলা হয়, ৮০টি মেডিক্যাল কন্ডিশনে স্টেম সেল প্রতিস্থাপন কার্যকর। স্নায়ুজনিত রোগে স্টেম সেল ট্রিটমেন্টে ভাল ফল মিলছে বলে মত চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের একাংশের। ব্লাড ক্যানসারের চিকিৎসাতেও কর্ড ব্লাড নতুন রক্ত সঞ্চালন করে রোগীর দেহে।
প্রক্রিয়াবিধি
শিশুর জন্মের পরেই এই কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করতে হয়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সংরক্ষণ প্রক্রিয়া সেরে ফেলতে হবে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এটি সংরক্ষণ করতে হয়। এ রাজ্যের বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা রয়েছে, যারা সংরক্ষণের কাজ করে। হাসপাতাল থেকে কর্ড ব্লাড নিয়ে সেটি ব্যাঙ্ক করা— সবটাই সংস্থা নিজের দায়িত্বে করে। যে অভিভাবক চাইছেন তাঁর সন্তানের কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করতে, তাঁকে সন্তান জন্মানোর আগেই ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কনট্র্যাক্টের মাধ্যমেই প্রক্রিয়াটি হয়।
কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটি খরচসাপেক্ষ। সাধারণত সন্তানের ন্যূনতম ২১ বছর এবং সর্বোচ্চ ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক করা হয়ে থাকে। শহরের এক নামী কর্ড ব্লাড সংস্থা জানাচ্ছে, ২১ বছরের জন্য ব্যাঙ্কিং করলে প্রায় ৫০ হাজার টাকা এবং ৭৫ বছরের জন্য প্রায় ৭৫ হাজার টাকা খরচ পড়বে। কিছু টাকা এককালীন এবং বাকিটা মাসিক কিস্তিতে দেওয়া যায়। তবে সংস্থাভেদে খরচের তারতম্য হয়। কমিউনিটি ব্যাঙ্কিংয়ের সুবিধে নিলে পরিবারের অন্যান্যরাও (নিকটস্থ) প্রয়োজনে স্টেম সেল ব্যবহার করতে পারবেন।
ভাই-বোনের স্টেম সেল ব্যবহারের ঘটনাই বেশি শোনা যায়। তবে ডোনারের মাধ্যমেও এই থেরাপি সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্লাড গ্রুপ একই হতে হবে, এমন নয়। হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেনের (এইচএলএ) কিছু কম্পোনেন্ট ম্যাচ করলে, তা ব্যবহার করা যায়।
বিতর্কসাপেক্ষ
লাইফসেল ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে অভিজিৎ পাল জানালেন, বছর পাঁচেক আগেও মাসে ১০-১২ জন অভিভাবক কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কিংয়ের জন্য আবেদন করতেন। সেই সংখ্যা ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুশোর কাছাকাছি। সংখ্যায় বাড়লেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও সচেতনতার অভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
শুধু সাধারণ মানুষই নন, চিকিৎসক মহলও দ্বিধাবিভক্ত কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক করা উচিত কি না, তা নিয়ে। গাইনিকলজিস্ট ডা. গীতশ্রী মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘আমি কাউকে রেফার করি না এ ব্যাপারে। কেউ করতে চাইলে নিজের দায়িত্বে করতে পারেন। কারণ কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক করে আদৌ কোনও সুরাহা হয় কি না, তা নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও নিশ্চিত নয়। অনেক তর্ক-বিতর্ক চলছে।’’ শিশু চিকিৎসক ডা. অপূর্ব ঘোষ বললেন, ‘‘বিষয়টি বিতর্কসাপেক্ষ। চেনাজানা পরিধির মধ্যে স্টেম সেল কাজে লাগানো হয়েছে, এমন ঘটনা শুনিনি।’’
চিকিৎসকেরা যেহেতু বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত নন, তাই সাধারণ মানুষের মনেও নানা সংশয় রয়েছে। জেনেটিক ডিজ়র্ডার থাকলে স্টেম সেল কার্যকর নয় বলেই চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মত। এ ছাড়া বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয় বলেও অনেক অভিভাবক পিছিয়ে আসেন।
কর্ড ব্লাড নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন আরও এক গাইনিকলজিস্ট অগ্নিবেশ চট্টোপাধ্যায়, ‘‘স্টেমসেল থেরাপি যে নিশ্চিত ভাবে কার্যকর হচ্ছে, তা বোধহয় বলা যায় না। এ নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। তা ছাড়া আমাদের মতো দেশে স্টেম সেল ঠিক মতো প্রিজ়ার্ভ করা হচ্ছে কি না, সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। বিদেশে এই নিয়ে কিছু কাজ সফল হয়েছে বলে শুনেছি। তবে নতুন গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, মেনস্ট্রুয়াল ব্লাড থেকেও স্টেম সেল পাওয়া যায়। এটা যদি বাস্তবে সম্ভব হয়, তা হলে মানুষ এত টাকা দিয়ে কেন ব্যাঙ্কিং করবেন!’’
সংক্রমণের ফলে স্টেম সেল নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এমন অভিযোগও উঠেছে। গত বছরই এমন একটি ঘটনা ঘটে, যার জন্য ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে অভিযোগও করা হয়। এ রাজ্যে সংরক্ষণের কোনও বন্দোবস্ত নেই। কর্ড ব্লাড সংগ্রহ করে ভিন রাজ্যে নিয়ে গিয়ে স্টোর করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় সামান্য এ দিক-ও দিক হলে জিনিসটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে। যদিও সব ব্যাঙ্কিং সংস্থাই আশ্বাস দেয় তাদের উপযুক্ত পরিকাঠামো ব্যবস্থার। এ ক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে কোনও ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা নেই। সবটাই বেসরকারি পরিষেবা। পাশাপাশি মাথায় রাখতে হবে, এ রাজ্যের স্টেম সেল থেরাপি করার মতো পরিকাঠামো প্রায় নেই বললেই চলে। তবে দিল্লি, চেন্নাই ও মুম্বইয়ের কিছু হাসপাতালে এই পরিকাঠামো রয়েছে।
কিছু সত্যি ঘটনা
কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কিং সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী সেরিব্রাল পলসি, থ্যালাসেমিয়া, অটিজ়মের ক্ষেত্রে স্টেম সেল থেরাপি কাজে আসার অনেক উদাহরণ ভারতেই রয়েছে। আসানসোলের এক ট্যাক্স কনসালট্যান্ট (অনুরোধের কারণে নাম-পরিচয় গোপন রাখা হচ্ছে) ২০১৩ সালে তাঁর ছেলের জন্য স্টেম সেল থেরাপি করে উপকৃত হয়েছেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দু’জনেই ছিলেন থ্যালাসেমিয়ার বাহক। বাবা-মা ক্যারিয়ার হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া পেশেন্ট হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাঁদের ছেলের জন্মের দু’মাসের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। কোন পথে চিকিৎসা করাবেন, সেই সন্ধান করতে গিয়ে স্টেম সেল থেরাপির কথা জানতে পারেন তাঁরা। তখন তাঁরা দ্বিতীয় সন্তানের পরিকল্পনা করেন। তাঁদের ছোট ছেলে থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলেও তার স্টেম সেল ব্যবহারে সমস্যা নেই। চেন্নাইয়ে গিয়ে বড় ছেলের বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করানো পরে, সে এখন সুস্থ। এই ট্রান্সপ্লান্টের ক্ষেত্রে খরচ পড়েছিল ২২ লক্ষ টাকা। আর পুরো প্রক্রিয়াটি মোটামুটি ভাবে ৩৫ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমাদের এখানে সচেতনতার অভাব রয়েছে। এখানকার চিকিৎসকেরাও উৎসাহ দেন না। বিদেশে কিন্তু অনেকেই সুফল পাচ্ছেন।’’
কলকাতার বাগুইআটিতে থাকেন অপূর্ব দে সিংহ। ছেলে অপ্রতিমের জন্মের ১৮ মাস পর থেকেই তার মধ্যে কিছু সমস্যা নজরে আসে তাঁর। কথা বলতে সময় নিচ্ছিল শিশুটি। ‘‘আমি নিজের সন্দেহের কথা এখানকার শিশু চিকিৎসককে জানিয়েছিলাম। উনি বলেছিলেন, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দু’বছর বয়সেও প্রোগ্রেস না হওয়ায় ছেলেকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে দেখালাম। তখন অটিজ়ম ধরা পড়ল। তার পরেই আমি স্টেম সেল ট্রিটমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি,’’ বললেন অপূর্ব।
ঠিক ওই সময়েই আমেরিকার ডিউক ইউনিভার্সিটি অটিজ়মের সমাধানের জন্য কর্ড ব্লাড স্টেম সেল ট্রিটমেন্ট নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিল। তারা তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের রিপোর্ট ২০১৭ সাল নাগাদ প্রকাশ করে। এর পরে অপূর্বর যোগাযোগ হয় ডিউক ইউনিভার্সিটির সঙ্গে, অপ্রতিমের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য। প্রসঙ্গত, অপূর্ব তাঁর ছেলের জন্মের সময়ে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করেছিলেন। বেশ কিছু পরীক্ষার পরে ২০১৭ সালে আমেরিকায় অপ্রতিমের থেরাপি হয়।
ছ’বছরের অপ্রতিম কোনও স্পেশ্যাল স্কুলে যায় না। আর পাঁচটা শিশুর মতোই বড় হচ্ছে সে। তার বাবার কথায়, ‘‘ছেলের কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কিংয়ের সময়ে ভাবিনি, এটা সত্যিই কোনও দিন কাজে লাগবে। স্টেম সেল থেরাপি কাজে এসেছে ওর ক্ষেত্রে। সোজা ভাষায় বললে, কিছু নন-ডেভেলপিং সেলের বদলে রাইট সেল প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই ঠিক সেল বাছাইয়ের পর্বটাই আসল। ও এখন আগের তুলনায় অনেকটাই প্রোগ্রেস করেছে। তবে আরও একবার স্টেম সেল থেরাপির প্রয়োজন রয়েছে।’’ প্রথম বার আমেরিকায় গিয়ে চিকিৎসা করাতে ২৫ লক্ষ টাকার মতো খরচ হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে সেই খরচ প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা। অপূর্বর কথায়, ‘‘প্রথম বার অন্যান্য জায়গা থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছিলাম। এ বার এখনও সংস্থান হয়নি। দ্বিতীয় দফার ট্রিটমেন্ট হলে হয়তো আমার ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে।’’
কর্ড ব্লাড স্টেম সেল থেরাপি নিয়ে চিকিৎসক মহল যেমন নিশ্চিত নন, তেমনই সাধারণ মানুষের মধ্যেও ধারণার অভাব রয়েছে। পাশাপাশি বিষয়টি খরচসাপেক্ষ। তাই সংরক্ষণ করার আগে ব্যক্তিগত সামর্থ্য এবং সব খুঁটিনাটি যাচাই করে নেওয়া উচিত।