সমীক্ষা বলে, সারা বিশ্বে প্রতি দুই সেকেন্ডে এক জন করে মানুষের রক্তের প্রয়োজন হয়। একই সঙ্গে সমীক্ষা এও বলে যে, ভারতের ক্ষেত্রে রক্ত দানের সঙ্গে সচেতনতা শব্দটির থেকেও যে শব্দটি জুড়ে রয়েছে তা হল ভয়। এখনও রক্ত দেওয়ার আগে মানুষ ভাবনায় পড়ে যান, আদৌ কাজটা ঠিক হচ্ছে তো?
২০০৫ সালে ওয়র্ল্ড হেল্থ অ্যাসেম্বলি ১৪ জুন তারিখটি রক্তদাতা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার ১ শতাংশ মানুষ যদি নিয়মিত রক্ত দান করেন, তা হলে সে দেশের ন্যূনতম রক্তের চাহিদা মেটে। ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা ১৩.৯ বিলিয়ন অর্থাৎ বলা যায় প্রতি বছর কমপক্ষে ১৩ মিলিয়ন ইউনিট রক্ত প্রয়োজন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সচল রাখতে। কিন্তু একাধিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে কখনওই সেই প্রয়োজন অনুসারে রক্তের জোগান হয় না। জাতীয় এডস নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রক (ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল অর্গ্যানাইজ়েশন)-এর ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভারতে প্রতিবছর কম করেও ১০ মিলিয়ন ইউনিট (এক ইউনিট সমান ৪৫০ মিলি) রক্ত প্রয়োজন হয়, কিন্তু ৭.৪ মিলিয়নের বেশি রক্তের জোগান কিছুতেই পাওয়া যায় না। সচেতনতার অভাবই এর অন্যতম কারণ। ফলে নিয়মিত রক্ত প্রয়োজন হয় যে সমস্ত মানুষের, তাঁদের পোহাতে হয় ঝক্কি।
রক্তের কী কী অংশ দান করা যায়?
রক্ত মানুষের দেহের তরল যোজক কলা, যা মূলত পরিবহণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। রক্তে থাকে রক্তকণিকা, প্লেটলেট ও প্লাজ়মা। এক ইউনিট রক্ত থেকে এই তিনটি জিনিসই ব্যবহার করা যায়, অর্থাৎ বলা চলে এক ইউনিট রক্ত কম করে তিন জন মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে। এক জন ডোনার ইচ্ছে করলে সমগ্র রক্ত বা হোল ব্লাডও দিতে পারেন, অথবা রক্তের বিশেষ উপাদান যথা প্লেটলেটও দান করতে পারেন। মানবদেহের মোট ওজনের শতকরা সাত ভাগ রক্ত থাকে। সাধারণত, এক জনের দেহ থেকে এক বারে এক ইউনিট রক্ত নেওয়া হয়। এই রক্ত দাতার দেহে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় তৈরি হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এর ফলে দাতার কোনও ক্ষতিও হয় না।
রক্তের গ্রুপ কী?
সাধারণত মানব দেহে আট ধরনের রক্ত দেখা যায়। সেগুলি হল, এ+, ও+, বি+, এবি+, এ-, ও-, বি-, এবি-। উল্লেখ্য, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় বি+ রক্ত এবং সবচেয়ে কম এবি- রক্তের গ্রুপ। রক্তে তিনটি অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি অনুসারে রক্তের গ্রুপ নির্ধারিত হয়। এই তিনটি অ্যান্টিজেন হল, এ অ্যান্টিজেন, বি অ্যান্টিজেন ও আর এইচ ফ্যাক্টর অ্যান্টিজেন। এই অ্যান্টিজেন অনুসারে এক জন অপর জনকে রক্ত দিতে পারে। রক্তের গ্রুপ যদি ভুল হয়, তবে গুরুতর শারীরিক সমস্যা থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
নিয়মিত রক্ত কাদের প্রয়োজন হয়
জন্মসূত্রে কিছু অসুখ, ক্যানসার বা জটিল অপারেশন হয়েছে, এমন ব্যক্তির নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হতে পারে। মাসে এক বার বা দু’বার রক্ত না দিলে এঁদের শারীরিক অবস্থার অবনতি অবশ্যম্ভাবী।
থ্যালাসেমিয়া-সহ বিভিন্ন হিমোলিটিক অ্যানিমিয়া: ভারতে থ্যালাসেমিয়া খুব পরিচিত একটি জিনঘটিত রোগ। এই অসুখে সারা জীবন ধরে মাসে কমপক্ষে দু’বার করে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজন হয়। এক মাত্র বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন হলে তবেই এ রোগ নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি বছর অন্তত এক লক্ষ থ্যালাসেমিক শিশুর জন্ম হয় সারা বিশ্বে। তাদের মধ্যে ১০ হাজার জনের জন্ম হয় ভারতে। থ্যালাসেমিয়ার মতো আর একটি অসুখ হল অটোইমিউন হিমোলিটিক অ্যানিমিয়া, যাতে নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হয়।
কিডনি সংক্রান্ত অসুখ ও রেনাল ফেলিয়োর: কিডনির অসুখে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজন হয়। নিয়মিত ডায়ালিসিস চলে এমন মানুষদের নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন। একই রকম ভাবে সাধারণ অ্যানিমিয়ায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁদেরও অনেক সময় রক্ত দিতে হয়।
ক্যানসার ও বিভিন্ন অঙ্কোলজিক্যাল সমস্যা:
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভারতে মোট ক্যানসার আক্রান্ত মানুষের ১.৬ থেকে ৪.৮ শতাংশের বয়সই ১৫ বছরের নীচে। নিয়মিত কেমোথেরাপির ফলে শরীরে অনেক সময়ই রক্তাল্পতা দেখা যায়, ফলে রক্তের প্রয়োজন হয়।
ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গি
ম্যালেরিয়াতে লোহিত কণিকার ক্রমাগত ক্ষয়ের ফলে রক্তশূন্যতা দেখা যায়। ফলে রক্তের প্রয়োজন হয়। একই ভাবে ডেঙ্গিতে ভীষণ ভাবে প্লেটলেট কমতে থাকে। ফলে বেশির ভাগ সময়ই রোগীকে প্লেটলেট দিতে হয়।
হিমোফিলিয়া
থ্যালাসেমিয়ার মতো এই জিনঘটিত অসুখটিতে নিয়মিত রক্ত দিতে হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ১০ হাজার জনে এক জনের এই রোগ থাকে।
রক্ত দেওয়ার নিয়ম
ইচ্ছে থাকলেও যে কেউ রক্ত দিতে পারবেন, তা নয়। যে কোনও দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা একই সঙ্গে রক্তদাতা ও গ্রহীতার স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখে।
* রোগ থাকলে: দাতার কোনও ছোঁয়াচে বা রক্ত দ্বারা বাহিত হতে পারে এমন অসুখ থাকলে, তিনি রক্ত দিতে পারবেন না।
এ ছাড়া, এডস, হার্টের রোগ, হাইপারটেনশন, ক্যানসার, এপিলেপ্সি, কিডনির অসুখ ও ডায়াবিটিস থাকলে রক্ত দেওয়া নিষেধ। যাঁদের অ্যানিমিয়া রয়েছে, রক্ত দেওয়ায় নিষেধ রয়েছে তাঁদেরও। হিমোগ্লোবিন যদি ১২.৫-এর নীচে হয়, তা হলে রক্ত দেওয়া যাবে না। পালস রেট যদি ৫০-এর কম ও ১০০-এর বেশি হয়, তা হলেও রক্ত নেওয়া হয় না। এ ছাড়া, হাঁপানি, টিবি বা কোনও ধরনের অ্যালার্জি থাকলেও রক্ত নেওয়া হয় না।
* বয়স ও ওজন: দাতার বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। কম পক্ষে ৫০ কেজি ওজন না হলে রক্ত দেওয়া বারণ। রক্ত দেওয়ার সময় দৈহিক তাপমাত্রা থাকতে হবে ৩৭.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রক্তচাপের সিস্টোলিক থাকতে হবে ১০০-১৮০, ডায়াস্টোলিক ৫০-১০০।
* পিয়ার্সিং ও ট্যাটু: রক্ত দানের আগের ছ’মাসের মধ্যে যদি ট্যাটু বা পিয়ার্সিং করানো হয়, তা হলেও রক্ত দেওয়া যাবে না।
* টিকাকরণ: রেবিজ়, হেপাটাইটিস বি টিকা নেওয়ার পর কম করে ছ’মাস পরে রক্তদান করা উচিত। তবে কোভিডের টিকা নেওয়ার দু’ থেকে তিন সপ্তাহ পর রক্ত দান করা যেতে পারে বলে কোনও কোনও ডাক্তারের মত।
* মদ্যপান: রক্ত দান করার আগের ২৪ ঘণ্টায় মদ্যপান করা চলবে না।
* গর্ভাবস্থায়: গর্ভবতী বা সদ্য মা হয়েছেন এমন মহিলা রক্তদান করতে পারেন না। এ ছাড়া, মিসক্যারেজ হওয়ার ছ’মাসের মধ্যে রক্তদান নিষিদ্ধ।
রক্তের অপচয়
পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে প্রতি বছর অন্তত ৬.৫ মিলিয়ন রক্ত ও রক্তের উপাদান নষ্ট হয়। শরীর থেকে রক্ত গ্রহণ করার এক মাসের মধ্যে রক্ত যদি কোনও রোগীকে না দেওয়া হয়, তা হলেই ধরে নেওয়া যায় সেই রক্ত নষ্ট হচ্ছে। সাধারণত, রক্ত ব্যবহার করতে না পারার জন্য ও ঠিক ভাবে না রাখার জন্য রক্ত নষ্ট হয়। এ ছাড়া রক্ত নেওয়ার সময়ে ব্লাড ব্যাগ নষ্ট হয়ে যাওয়া, প্রশিক্ষিত প্যারামেডিকের অভাব, রক্ত নিয়ে আসার ঠিক পদ্ধতির অভাবেও অনেক সময় রক্ত নষ্ট হয়।
ভোরুকা ব্লাড ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর তানিয়া দাসের কথায়, “রক্ত দানের ক্যাম্প করাটা এখন ক্লাবগুলোর কাছে একটি প্রতিযোগিতার মতো হয়ে গিয়েছে। ফলে বহু ক্ষেত্রেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রক্ত গ্রহণ হয়ে যায়। এখন, রক্তের তিনটি উপকরণের এক্সপায়ারির তিনটি আলাদা সময় রয়েছে, হোল ব্লাড ও রেড ব্লাড সেল কম করে ৩৫-৩৬ দিন ভাল থাকে। প্লেটলেট থাকে ৫ দিন। আর প্লাজ়মা থাকে এক বছর। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি রক্ত নেওয়া হয়ে গেলে অনেক সময়ই রক্ত নষ্ট হয়। ফলে ড্রাই সিজ়নে রক্ত পাওয়া হয়ে যায় মুশকিল।”
রক্তের চাহিদা ও জোগানের অসামঞ্জস্য, সঙ্গে পরিকল্পনার অভাবে এই অপচয়... অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।